শাহজালালে রেডলাইনের নিরাপত্তা সক্ষমতায় প্রশ্ন

DSJ-70-22-03-2016হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োগ পাওয়া যুক্তরাজ্যের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রেডলাইন এভিয়েশন সিকিউরিটির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরাপত্তা নিয়ে বিমানবন্দর পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন না আসায় এই প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্ট মহলে। তারা বলছেন, ভবন ও প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় যাদের অভিজ্ঞতা, তাদেরই দেওয়া হয়েছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব। এ ছাড়া রেডলাইন কী কাজ করছে, তা মনিটরিং করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবলও নেই সিভিল এভিয়েশনে। এমন এক পরিস্থিতিতে ঝুঁকির মধ্যেই থাকছে যুক্তরাজ্যগামী যাত্রীবাহী ফ্লাইট। সরাসরি যুক্তরাজ্যে কার্গো ফ্লাইটের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে কি-না, তা স্পষ্ট হবে আগামী ১১ এপ্রিল ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি)-এর কর্মকর্তারা ঢাকায় আসার পর।

বিমানবন্দর সূত্র জানায়, গত মাসে কার্গো ফ্লাইটের ওপর যুক্তরাজ্যের ডিএফটির নিষেধাজ্ঞা জারির পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় পরিবর্তন আনা হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় সব পয়েন্টেই। যুক্তরাজ্যের রেডলাইন দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই একই ধরনের নিরাপত্তা বহাল থাকে। রেডলাইন কাজ শুরুর পরও সন্দেহ দূর না হওয়ায় শাহজালালে যুক্তরাজ্যগামী যাত্রীবাহী ফ্লাইটের যাত্রী ও লাগেজে তল্লাশি করা হচ্ছে একাধিকবার। এতে করে ফ্লাইট শিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের কাজ দেওয়া হয় যুক্তরাজ্যের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রেডলাইন এভিয়েশন সিকিউরিটিকে। গত ২১ মার্চ রেডলাইনের সঙ্গে দুই বছরের জন্য সরকারের চুক্তি হয়। আর এ জন্য রেডলাইনকে দেওয়া হবে ৭৪ কোটি টাকা। মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্য সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানো এবং বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। চুক্তির পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, তারা যেভাবে বলছে, আমরা সেভাবেই নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিয়েছি। নিরাপত্তার ‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে’ ঘাটতি থাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে যুক্তরাজ্য গত ৮ মার্চ থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দুই দেশের সম্মত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপত্তা জোরদারের কাজ শুরু না হলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের যুক্তরাজ্যগামী সরাসরি ফ্লাইট নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে এ কথা জানান। এমন পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। যুক্তরাজ্যের এই সময়সীমা পেরিয়ে গেছে গত ৩১ মার্চ। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য চারটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করে। সেগুলো হলো— গ্রুপ ফোরএস, রেডলাইন, রেসট্রাটা ও ওয়েস্ট মিনিস্টার গ্রুপ পিএলসি। কিন্তু গ্রুপ ফোরএসের প্রতিনিধি মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার মতো বিশেষায়িত কাজে তাদের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। পরে মন্ত্রণালয় ও বেবিচকের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে একটি প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়া হবে। সূত্রমতে, কার্যত রেডলাইনকে কাজ দেওয়ার জন্য অন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনাতেই বসেনি মন্ত্রণালয় ও বেবিচক। হিথরোসহ বিশ্বব্যাপী ৮০টি বিমানবন্দরে নিরাপত্তা সহযোগিতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্রিটিশ কোম্পানি ওয়েস্ট মিনিস্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিটার ফোওলার যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় অবস্থান করলেও মন্ত্রণালয়ের কেউ সাক্ষাৎ দেননি। ওয়েস্ট মিনিস্টারের এই কর্মকর্তাকে সাক্ষাতের সময় দেওয়া হয় ২২ মার্চ সন্ধ্যায়। অথচ সেই দিন বিকালেই রেডলাইনের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করে ফেলে মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, রেডলাইন একটি প্রশিক্ষণভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। তাদের সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি মূলত অফিস ও বাসায় নিরাপত্তা সহযোগিতা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে ওয়েস্ট মিনিস্টারের প্রশিক্ষণ সক্ষমতাসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও প্রযুক্তিগত সব ব্যবস্থা রয়েছে। নিরাপত্তা উন্নয়নে দুই বছরের জন্য এই কোম্পানিটি চেয়েছে ৫০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে রেডলাইনের সঙ্গে চুক্তি করা হয় ৭৫ কোটি টাকায়।

বেবিচকের একটি সূত্র বলেছে, বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর হিসেবে যুক্তরাজ্য সরকার যে কয়েকটি দেশের বিমানবন্দরের তালিকা করেছে এর মধ্যে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট গত জানুয়ারি মাস থেকেই শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। তারা ছদ্মবেশে কার্গো ভবনে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তারা দেখতে পান, মালামাল স্ক্রিনিং করা হচ্ছে নামমাত্র। ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট কার্গোতে করে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে প্যাকেট পাঠান। তারা জানতে পারেন, সেই প্যাকেটটি ঠিকমতো স্ক্রিনিং করা হয়নি। এতে যুক্তরাজ্য অসন্তোষ প্রকাশ করে শাহজালালের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। সূত্র জানায়, যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট ২০০৭ ও ২০০৯ সালে দুবার বাংলাদেশকে পণ্য পরিবহন স্থান, যাত্রী ও তাদের পণ্য তল্লাশি এবং বিমানবন্দরের কর্মরত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কী ধরনের নীতিমালা ও পদক্ষেপ নিতে হবে তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছিল। অথচ ওই দুটি প্রতিবেদনকে সরকার বিবেচনায় নেয়নি। এমনকি যুক্তরাজ্য নিজেদের অর্থায়নে ২০০৬ ও ২০০৭ সালে বেবিচকের ৪০ জন জনবলকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। তাদেরও ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। পরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দও থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহনে যুক্তরাজ্য গত ৮ মার্চ থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সূত্র জানায়, রেডলাইন নামে এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হলো, যাদের এভিয়েশন নিরাপত্তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাও দেওয়া হলো বেশি দরে। শুধু প্রশিক্ষণের জন্য ৭৪ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে রেডলাইনকে। ১০ দিনেও তাদের ৩৯ জন সদস্য শাহজালালে এসে পৌঁছেনি। ২৯ জন সদস্য প্রশিক্ষণের কাজ করছেন। অথচ আরও কম দরে যারা আবেদন করেছিল তাদের আলাপ-আলোচনাতেই রাখা হয়নি। ওয়েস্ট মিনিস্টার যুক্তরাজ্যের ১১টিসহ অস্ট্রেলিয়া, ইরাক, সৌদি আরব, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বিভিন্ন দেশের ৮০টি বিমানবন্দরে কাজ করছে। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই কোম্পানিটি কম দরে কাজ নিতে চাইলেও রহস্যজনক কারণে এই কোম্পানিকে আলোচনাতেই রাখা হয়নি।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.