বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবা ব্যবহারে পিছিয়ে থাকার মূল কারণ দারিদ্রতা! উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত ৫১টি দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারের সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশের বর্তমানে অবস্থান ৩৩তম। আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট সংগঠন অ্যালায়েন্স ফর অ্যাফোর্ডেবল ইন্টারনেটের (এফোরএআই) ‘অ্যাফোর্ডেবিলিটি রিপোর্ট ২০১৫-১৬’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্বব্যাংক থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত নিয়ে তৈরি এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা (পিপিপি) দৈনিক ১ দশমিক ৯ ডলার বা ১৫২ টাকা। ওই পর্যায়ের একজন মানুষের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ন্যূনতম একটি সংযোগ নিতে খরচ পড়ে ১৫২ টাকার ১৪ শতাংশ অর্থাৎ ২২ টাকা। আর দৈনিক গড়ে ৩ দশমিক ১ ডলার আয় করেন বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭৮ শতাংশ। তাঁদের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের একটি সংযোগ নিতে মোট আয়ের প্রায় ৯ শতাংশ ব্যয় করতে হয়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫১টি দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের খরচ একজন ব্যক্তির গড় মাসিক আয়ের ৪০ শতাংশ। খুব ছোট আকারের ইন্টারনেট প্যাকেজের খরচও এসব দেশে একজন ব্যক্তির মাসিক আয়ের ১০ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উচ্চমূল্যই ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রধান বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কম ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, এমন পর্যবেক্ষণও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
এ জন্য নারী-পুরুষের আয়-বৈষম্যকেই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারীদের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা ইন্টারনেট ব্যবহার সক্ষমতায় পিছিয়ে আছেন। এ জন্য গ্রামাঞ্চলের মানুষের নিম্ন আয় ও ইন্টারনেট অবকাঠামোর অভাবকেই প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহার উপযোগী মোবাইল ফোন ও অন্যান্য যন্ত্রের মূল্য এখনো সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে না আসার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, দেশটিতে একটি স্মার্টফোন কিনতে একজন নাগরিককে তাঁর গড় মাথাপিছু আয়ের (জিএনআই) ২৪ দশমিক ১ শতাংশ খরচ করতে হয়।
তানজানিয়া ও ইথিওপিয়াতে এ খরচ আরও বেশি, যথাক্রমে ৬২ ও ৮০ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়াতে মোবাইল ফোন অপারেটর ও হ্যান্ডসেট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো ‘যন্ত্র খরচ বা ডিভাইস কস্ট’ কমাতে যে কাজ করছে, সে বিষয়টিও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। স্মার্টফোনের দাম এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে আগের চেয়ে ৩০ শতাংশ কমে আসার বিষয়টি তুলে ধরে বলা হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো সিংহভাগ স্মার্টফোনের গড়মূল্য ১০০ ডলার বা ৭ হাজার ৬০০ টাকা, যা দৈনিক গড়ে ১৫৬ টাকা আয় করা মানুষদের জন্য অনেক বেশি।
প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, যে ৫১টি দেশকে এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এর মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ নিতে খরচ পড়ে মাথাপিছু গড় আয়ের ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চমূল্যই স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রধান বাধা হয়ে দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশে এ খরচের হার সাড়ে ৬ শতাংশ। বর্তমান প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান আগের বছরের মতো অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রতিবেদনটির তৃতীয় সংস্করণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের আগে আছে ভারত ও পাকিস্তান। তালিকায় পাকিস্তান ২৫তম ও ভারত ৩১তম স্থানে আছে। তালিকার শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও পেরু। এ তালিকায় থাকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচ অবস্থানে আছে রুয়ান্ডা, উগান্ডা, গাম্বিয়া, মিয়ানমার ও তানজানিয়া। র্যাংকিং নির্ধারণে শূন্য থেকে ১০০ স্কেলে নম্বর দেওয়া হয়েছে। নম্বর দেওয়া হয় ইন্টারনেট সেবার অবকাঠামোর মান ও কতসংখ্যক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে তার ভিত্তিতে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে প্রাথমিক ও স্থায়ী (সেকেন্ডারি)—উভয় ধরনের তথ্যই ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইন্টারনেট সেবার অবকাঠামো মানের জন্য ৪৫ দশমিক ০৪ ও ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণের জন্য ৩৩ দশমিক ৭৩ নম্বর পেয়েছে। দুটির গড়ে বাংলাদেশের স্কোর দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ১৩। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩৭ দশমিক ১। এবারে প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ভারতের স্কোর যথাক্রমে ৪৪ দশমিক ১১ ও ৪০ দশমিক ১২। আর শীর্ষে থাকা কলম্বিয়ার স্কোর ৬৫ দশমিক ৩২।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে অবশ্য একটি ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশটিতে মোবাইল ফোনভিত্তিক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম তালিকার সব দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। বাংলাদেশে স্বল্প আয়ের ৮০ শতাংশ মানুষ মাসে ৫০০ মেগাবাইট (এমবি) ইন্টারনেট ডেটা প্যাক কেনার সামর্থ্য রাখেন, যা এই শ্রেণির গড় আয়ের সাড়ে ৩ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশে পুরুষদের তুলনায় নারীরা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কম ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এমন পর্যবেক্ষণও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। এ জন্য নারী-পুরুষের আয়-বৈষম্যকেই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান ধারা চলতে থাকলে বিশ্বের সব মানুষকে ইন্টারনেটের আওতায় আনতে ২০৪২ সাল পর্যন্ত লেগে যাবে। কিন্তু জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য ইন্টারনেট প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিশ্বের ১৯৩টি দেশ সম্মত হয়েছে। তাই সমস্যা সমাধানে সুষ্ঠু নীতিমালার মাধ্যমে ইন্টারনেটের দাম কমিয়ে আনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
বেশ কিছু পরিসংখ্যান ব্যবহার করে এ প্রতিবেদনে সঠিক নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নকে স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য পাঁচটি বিষয়কে এ ক্ষেত্রে সাফল্য লাভে মূল চাবিকাঠি বলা হয়েছে। এগুলো হলো কার্যকর ইন্টারনেট ব্যবহার নীতিমালা তৈরি, ইন্টারনেট সেবাদাতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব তৈরি, কার্যকর তরঙ্গ ব্যবহার নীতিমালা প্রণয়ন, একই ইন্টারনেট অবকাঠামো মিলেমিশে ব্যবহারের সুযোগ ও স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট সেবার বৈশ্বিক সুযোগ উন্মুক্ত করা।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে প্রথম ৪৬টি উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার ও মূল্যভিত্তিক এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এফোরএআই। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ প্রকাশিত সম্পূর্ণ প্রতিবেদন দেখা যাবে http://goo.gl/U5wY9r এই ঠিকানায়।