শাহজালালে ২০০ লাগেজ উধাও হচ্ছে প্রতিদিনই

luggageঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যেও সক্রিয় রয়েছে লাগেজ কাটা চক্র। সাম্প্রতিক সময়ে কড়াকড়ি বাড়লেও প্রতিদিন যাত্রীদের গড়ে দুইশ’ লাগেজ খোয়া যাচ্ছে। বিমানবন্দরে কর্মরত পুলিশ, কাস্টমস, বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছত্রছায়ায় ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখার মাধ্যমে লাগেজ কাটা ও চুরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অন্তত অর্ধশত লাগেজ পার্টি। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি ও তৎপরতায়ও থামছে না লাগেজ চুরি ও কাটাকাটি। এসব ঘটনায় সিভিল এভিয়েশন কর্মীরা দায়ী করছে বিমানকর্মীকে; বিমানকর্মীরা আবার দায়ী করছে সিভিল এভিয়েশনকে। সাধারণ যাত্রীরা তো বটেই, ভিআইপিরাও নিয়মিত লাগেজ হয়রানির শিকার হচ্ছেন এখন। বর্তমান সরকারের একাধিক মন্ত্রীও ইতিমধ্যে লাগেজ খোয়া যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। যাদের মধ্যে রয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সাবেক বিমানমন্ত্রী জি এম কাদের। লাগেজ কাটার শিকার হয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বিমানবন্দরে লাগেজ বিড়ম্বনা কমাতে একাধিকবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত হয়েছে। লাগেজ কাটা ও চুরির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযান চালানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ যাত্রীর পাশাপাশি অনেক ভিআইপি যাত্রীর লাগেজও কাটা হচ্ছে। যা আমার জন্য বিব্রত। এ নিয়ে একাধিক তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে। কিন্তু তা বন্ধ করা যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সিসি ক্যামেরা বসিয়েও তাদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না।’ লাগেজ চক্রকে চিহ্নিত করে নির্মূল করার লক্ষ্যে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়েও বিকল্প ভাবা হচ্ছে বলে তিনি জানান। অচিরেই যাত্রীরা এ সমস্যা থেকে রক্ষা পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

যাত্রীদের সাম্প্রতিক লাগেজ ভোগান্তি :বিমানবন্দরে বিভিন্ন ফ্লাইট থেকে লাগেজ ওঠা-নামার দায়িত্বে (গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) রয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ। কিন্তু লাগেজ ভোগান্তি থেকে যাত্রীদের রক্ষা করতে পারছে না তারা। বিমান থেকে নেমে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও লাগেজ পাচ্ছেন না। আবার পেলেও তাতে মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ করে সমাধান পাওয়া দূরে থাক, যাত্রীকেই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ফলে কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডাও নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দরে লাগেজ চক্রের শিকার হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক নাগরিক। ভোর সাড়ে ৫টায় তার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে শাহজালাল

বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি। ইমিগ্রেশন আনুষ্ঠানিকতা শেষে কাস্টমস হলে সিভিল এভিয়েশনের কনভেয়ার বেল্ট থেকে ৩টি লাগেজ সংগ্রহ করেন তিনি। এ সময় একটি লাগেজ কাটা অবস্থায় পাওয়া যায়।

গত ২৭ জানুয়ারি প্যারিস থেকে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে আসেন সরকারি কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিক। তার সঙ্গে ছিল দুটি লাগেজ। বিমানবন্দরে নামার পর একটি লাগেজ পেলেও অন্যটি পাননি। এক সপ্তাহ পর তিনি লাগেজটি বুঝে পান। কিন্তু লাগেজে থাকা কোনো মালপত্র পাননি।

এমন আরেকজন ময়মনসিংহের ফুলপুরের আবদুল লতিফ। চার বছর পর গত ৫ মার্চ দুবাই থেকে এমিরেটস ফ্লাইটে দেশে আসেন তিনি। তার লাগেজে ছিল প্রিয়জনের কিছু দামি কসমেটিক্স, বাচ্চার চকোলেট আর কিছু ইলেকট্রনিক্স আইটেম। বিমানবন্দরে নামার আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি লাগেজ পান তালা ভাঙা অবস্থায়। কষ্টে অর্জিত টাকায় প্রিয়জনের জন্য কেনা জিনিসপত্র চুরি যাওয়ায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার মাথায়।

যেভাবে লাগেজ কাটা হয় :বিমানবন্দর-সংশ্লিষ্ট একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, বিমান থেকে লাগেজ বেল্টে দেওয়ার আগ মুহূর্তে লাগেজ কেটে মূল্যবান মালপত্র সরিয়ে ফেলা হয়। অনেক সময় যাত্রীদের জানানো হয়, লাগেজ আসেনি। বলা হয়, পরবর্তী ফ্লাইটে আসবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘পরবর্তী ফ্লাইটে’ লাগেজ এলেও তা আর প্রকৃত মালিকের কাছে পেঁৗছানো হয় না। লাগেজে দামি মালপত্র থাকলে তো কথাই নেই। জানানো হয়, ওই লাগেজে অবৈধ মালপত্র এসেছে। গোয়েন্দারা লাগেজের মালিককে খুঁজছে। এ ধরনের মিথ্যা বলে আতঙ্কের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয় যাত্রীদের। এমন পরিস্থিতিতে অনেক যাত্রীই লাগেজের আশা ছেড়ে দেন। অনেক সময় মোটা টাকার বিনিময়ে লাগেজ সংগ্রহ করা হয়।

প্রতিদিনই বিদেশফেরত যাত্রীরা তাদের লাগেজ পেতে এরকম দুর্ভোগের মুখে পড়ছেন। অনেকে হারানো লাগেজের খোঁজে দিনের পর দিন ধরনা দিচ্ছেন ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ শাখায়। ঘুরতে ঘুরতে ত্যক্তবিরক্ত যাত্রীদের অনেকে আবার ব্যাগ ফেরত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিচ্ছেন।

লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগে নানা অনিয়ম :যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে সম্প্রতি লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখার অফিস সময় সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নির্ধারণ করে এতে দুটি শিফট চালু করা হয়। এর আগে এটি সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এক শিফটেই চলত। কিন্তু দুই শিফটে অফিস খোলা রাখার নির্দেশনা না মেনে ওই বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিরা আগের মতোই এক শিফটে অফিস চালিয়ে দুই শিফটের কার্যক্রম দেখানোর পাশাপাশি নতুন নিয়মে বেতন-ভাতা নিচ্ছিলেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখা আগের নিয়মে চলায় সেখানে কর্মরত ব্যক্তিরা সন্ধ্যার পরপরই চলে যেতেন। স্টোর বন্ধ করে চাবি নির্ধারিত রুমে রেখে সিকিউরিটিরা অফিস ত্যাগ করতেন। তখন অন্য বিভাগের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ওই চাবি দিয়ে স্টোর ব্যবহার করে লাগেজ কেটে মাল চুরি করতেন।’

বিমানবন্দর এপিবিএনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন শিমুল বলেন, ‘বিমানসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্স কর্মীকে এ ধরনের অবৈধ মালপত্রসহ হাতেনাতে আটক করা হয়। এ সময় তল্লাশি করে দেহ থেকে স্বর্ণ, মোবাইল ফোন সেট, ঘরি, ইলেকট্রনিক্স বিভিন্ন মালপত্র উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে আটক কর্মীরা স্বীকার করেন, বিভিন্ন ফ্লাইটে মালপত্র ওঠানামার সময় কৌশলে লাগেজ থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়া হয়।

লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড শাখায় বিভিন্ন অনিয়ম প্রকট হয়ে ওঠায় কয়েকদিন আগে এক কর্মকর্তাকে জরিমানা করা হয়েছে। বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘ইকবাল হোসেন নামে দুবাইফেরত এক ব্যক্তির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ এপ্রিল লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগে অভিযান চালিয়ে নানা অনিয়ম ধরা পড়ে। এ কারণে সিকিউরিটি ডিএসও ইফতেখারকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।’

সূত্রঃ সমকাল

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.