এভিয়েশন নিউজ: সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে হজের টিকিট। টিকিটের মালিক সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্স- কারও কাছেই নেই হজের কাক্সিক্ষত টিকিট। হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে তা। এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৫ হাজার হজ যাত্রী জেদ্দা পৌঁছেছেন। বাকি রয়েছেন ৫৫ হাজার। এরমধ্যে বিমানের মাধ্যমে গেছেন ২৩ হাজার ৫৬২ জন। এ অবস্থায় টিকিটের খোঁজে হন্যে হয়ে সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিচ্ছে হজ ও ট্রাভেল এজেন্সিওগুলো। সাধারণ হজযাত্রীও আছেন এ তালিকায়। এ সুযোগে ১০ থেকে ১৫টি হজ ও ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগসাজশ করে টিকিটপ্রতি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিচ্ছে বিমানের একটি সিন্ডিকেট।
বিমানের এ সিন্ডিকেটের হোতা মতিঝিল সেল্স অফিসের দুর্নীতিবাজ জেনারেল ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) শামসুল করিম ও সাবেক এক্সেস ব্যাগেজ কেলেংকারির নায়ক মোঃ আশরাফ। লন্ডন ও জেদ্দা অফিসে থাকাকালীন এ দুই কর্মকর্তার দুর্নীতি বিমানে ওপেন সিক্রেট। তারপরও রহস্যজনক কারণে এবারের হজ টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের।
সরকারি হিসেবে বিমানের হজ টিকিট বিক্রির কথা ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪ টাকায়। কাগজে-কলমে দাম ঠিক দেখালেও বিমান অফিস থেকে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোকে টিকিটি কিনতে হচ্ছে গড়ে ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে। আর ট্রাভেল এজেন্সিরা হজ যাত্রীদের কাছে সেই টিকিট বিক্রি করছে আরও কমপক্ষে ৫-১০ হাজার টাকা বেশি দামে।
হজ শুরু হওয়ার আগের ১০ দিন টিকিটের চাপ থাকে বেশি। সাধারণত উচ্চবিত্ত ও ব্যবসায়ীরা শর্ট প্যাকেজ নিয়ে শেষ দিকে হজ পালন করতে জেদ্দা যান। এ কারণে এ সময় টিকিটের চাহিদা থাকে বেশি। আর এ বিশেষ চাহিদাকে পুঁজি করে বিমান ও সৌদিয়া এবারের শর্ট প্যাকেজের টিকিট বিক্রি করছে গড়ে ৫০ হাজার টাকা বেশি দামে।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) নেতাদের অভিযোগ, হজ টিকিটের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় দুটি বিমান সংস্থা প্রতি বছর হজের টিকিট নিয়ে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে। আটাব নেতা মুহায়েমিন সালেহ যুগান্তরকে জানান, এবারও সেই লুটপাট চলছে। তিনি বলেন, ১০ থেকে ১৫টি হজ ও ট্রাভেল এজেন্সির কাছে জিম্মি হজ যাত্রীরা। এই সিন্ডিকেট ঘুষ দিয়ে বিমান ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্সকে ম্যানেজ করে সব টিকিট নিজেরাই কিনে নেয়। এরপর শুরু করে মনোপলি ব্যবসা। বিকল্প না থাকায় হজ যাত্রীরাও বেশি দামে টিকিট কিনতে বাধ্য হন।
বিমানের মতিঝিল অফিসের জিএম শামসুল করিম জানান, হজ টিকিট নিয়ে এবার কোনো সমস্যা নেই। সব ধরনের নিয়ম-নীতি মেনে এজেন্সিগুলোকে টিকিট দেয়া হচ্ছে। শর্ত পূরণ করতে না পারায় অনেক এজেন্সিকে টিকিট দেয়া যাচ্ছে না। এরাই নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি জানান, বেশি দামে টিকিট বিক্রি করার কোনো সুযোগ নেই। এবারও বিমান ও সৌদিয়া এয়ারলাইন্স তাদের সব টিকিট তুলে দিয়েছে গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানের হাতে। এর অন্যতম হল- সুরেশ্বর ট্রাভেল, সানজেরি ট্রাভেল, আল গাজী ট্রাভেল, মুনা ট্রাভেল, ইসলামীয়া, ইস্টার্ন, কাজী এয়ার, এয়ারট্রিপ, রয়েল, মেগাটপ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাভেল এজেন্ট জানান, তারা এ বছর সাড়ে ৩শ’ হজ যাত্রী সৌদি আরব পাঠাবেন। বেশিরভাগ যাত্রী বিমানে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও বিমানের কাউন্টারে গিয়ে কোনো টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে বেশি দামে বিমানের মনোনীত ট্রাভেল এজেন্টের কাছ থেকে টিকিট কিনতে হচ্ছে।
নিয়মানুযায়ী বিমানের তালিকাভুক্ত সব ট্রাভেল এজেন্টের কাছে হজের টিকিট থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটা নেই। অনেক এজেন্সি দিনভর বসে থেকে টিকিট বুকিং করে টাকা জমা দিয়ে যখন টিকিট কিনতে যাচ্ছে তখন কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে তাদের পিএনআর (প্যাসেঞ্জার নেম রেকর্ড) বাতিল হয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, এভাবে শামসুল করিম ও আশরাফ সিন্ডিকেট অন্য এজেন্সির কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে একের পর এক পিএনআর বাতিল করে সে টিকিট অন্য এজেন্সির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে। আর হজ যাত্রীরা কাউন্টারে গেলে বলা হচ্ছে, টিকিট নেই। এভাবে এবারের হজ টিকিট বিক্রি করে ইতিমধ্যেই বিমানের সিন্ডিকেট ১০ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে।
বিমানের মার্কেটিং বিভাগের ভারপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজারের বিরুদ্ধে এর আগেও সাধারণ টিকিট বিক্রি নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এরপরও তাকে ডিজিএম থেকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে জিএম করা হয়। তার অশুভ কর্মতৎপরতায় এক বছরে বিমানের মতিঝিল অফিসের টিকিট বিক্রিতে ধস নেমেছিল। অর্ধেকে নেমে আসে এ অফিসের আয়। আগে প্রতি মাসে যেখানে ৪৫ কোটি টাকার টিকিট বিত্রি হতো। সেখানে শামসুল করিম যোগ দেয়ার পর সেটা নেমে আসে ২০ কোটিতে। তারপরও রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অভিযোগ আছে, অদক্ষ ও অযোগ্য এ কর্মকর্তা লন্ডন অফিসের রিজওনাল ম্যানেজার থাকাকালীন ৩ বছর আগে কেএমসি নামের একটি ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে ৪৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। সাবেক এমডি জাকিউল ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় এ ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো তাকে রিজিওনাল ম্যানেজার থেকে উপ-মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। লন্ডনে তার বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি আছে। বিমানে চাকরির সুবাদে তিনি লন্ডনের নাগরিকত্বও নিয়েছেন। এখন তদবির করে দুবাইতে পোস্টিং নেয়ার পাঁয়তারা করছেন।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, এ কর্মকর্তা চার বছর লন্ডন অফিসে ছিলেন। তার আমলে বিমানের ব্রান্ড নিউ বোয়িং ৭৭৭-৩০০ এয়ারক্রাফট অরুণ আলো ও পালকি চালিয়ে ৮ মাসে ৮৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে বিমান। এক্সেস ব্যাগেজ কেলেংকারির গডফাদার হিসেবে তার নাম বিমানের শীর্ষে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ কর্মকর্তা সিলেটি মালিকানাধীন কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্ট ও লন্ডনের সাবেক কার্গো জিএসএ আনা এভিয়েশনের সঙ্গে গোপনে যোগসাজশ করে বিমানের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
একই অভিযোগ আশরাফের বিরুদ্ধেও আছে। আশরাফ জেদ্দা অফিসের দায়িত্বে থাকালীন সেখানকার জিএসএ ইলাফ এভিয়েশনের সঙ্গে যোগসাজশে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
– মুজিব মাসুদ