বিমানবন্দর যেন সোনার খনি

Gold_Sonaএভিয়েশ নিউজ: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেন সোনার খনি। চলতি মাসের এ পর্যন্ত ১৫ মাসে প্রায় ১৭ মণ সোনা ধরা পড়েছে। সে সাথে চোরাচালানের সাথে জড়িত ৭৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বিমানবন্দর কাস্টমস, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক দৃষ্টির পরও থেমে নেই সোনার চোরাচালান। বিমানবন্দরের লাগেজ বেল্টগুলোর একটিতেও স্ক্যানার নেই। অনেকগুলো বহির্গমন পথ থাকায় চোরাচালানিরা সহজেই সোনার বার নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম শাহআমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে চোরাচালানিরা ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের ডিজি মইনুল খান বলেন, এক বা দু’জন নয়; চোরাচালানের সাথে অনেকে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি বড় ধরনের সোনা চোরাচালানের ঘটনায় আটক কয়েকজনকে রিমান্ডে নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় গোয়েন্দা পুলিশ কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে চক্রের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে। গোয়েন্দা পুলিশের সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের একশ্রেণীর লোকের সাথে আগে থেকে যোগাযোগ করেই চোরাচালানিরা সোনার চালান নিয়ে আসে।

যেসব চালান ধরা পড়ে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে নিরাপত্তা বলয় টপকে বেরিয়ে যায়। চক্রের একাধিক সদস্য সাথে অল্প অল্প করে নিয়ে নিরাপদে সটকে পড়ে। আটককৃতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সোনা চোরাচালানের সাথে ১৪টি চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। বিমানবন্দরে সবার দৃষ্টির আড়ালে সোনার চালান নির্বিঘ বের করার জন্য চক্রগুলো প্রতিনিয়ত কৌশল পাল্টায়। অভিনব কায়দায় কখনো চায়ের ফ্লাস্ক, বিদেশি বিস্কুটের প্যাকেট, জুসের প্যাকেট, জুতার ভেতর, প্যান্টের বেল্টের ভেতর, নারীর চুলের খোঁপায়, দেহের গোপনীয় জায়গায়, ল্যাপটপ এমনকি ওয়াটার পাম্পের ভেতরে করে সোনার বার পাচার হচ্ছে। পাচার হওয়া কিছু সোনার বার দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়লেও সীমান্ত পথে বড় অংশ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ অন্যান্য দেশে চলে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, সোনা চোরাচালান চক্রের বহনকারীরা ধরা পড়ে। পর্দার আড়ালের চরিত্রগুলো শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও তারা সব সময় অধরাই থেকে যায়। কোন তথ্য প্রমাণ না থাকায় তাদের কখনোই আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। একই কথা বলেছেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সিনিয়র এএসপি মো. আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের কাস্টমস হলের অভ্যন্তরে এপিবিএন সতর্ক দৃষ্টি রাখে। সোনার বার নিয়ে কাস্টমস হলের বাইরে আসার পরই এপিবিএন অভিযান পরিচালনা করে।

পুলিশের সূত্র জানায়, ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে যে পরিমাণ সোনার বার চোরাইপথে আসে স্থানীয় বাজারে তার খুব কমই ব্যবহার হয়। বেশিরভাগ চালানের সাথেই দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত। আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে সোনার চালান নিয়ে আসে। পরে এখান থেকে সীমান্ত পথে ভারতসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশে চলে যায়।

এদিকে বিমানবন্দরের সূত্র জানায়, অনেকগুলো বহির্গমন পথ থাকায় চোরাচালানিরা সহজেই সোনার বার নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে একটি বিশেষায়িত বর্হিগমন পথ চালুর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হয়েছে। অপরদিকে কাস্টমস হলে ৮টি লাগেজ বেল্ট রয়েছে। তবে বেল্টগুলোর একটিতেও স্ক্যানার নেই। স্ক্যানার থাকলে সহজেই লাগেজে লুকিয়ে রাখা সোনার বার ধরা পড়াসহ যাত্রীকে আটক করা সহজ হত। এছাড়া দেশে-বিদেশে সোর্স নিয়োগ করে চোরাচালানীদের চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনা করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কার্যক্রম আরো বাড়ানো হয়েছে। সোনা চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে আমর্ড পুলিশসহ সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আর এ কারণে রেলওয়ে স্টেশন, বাস টার্মিনাল ও সীমান্ত পথে সোনার বারসহ চক্রের লোকজন প্রায়ই ধরা পড়ছে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের ডিজি মইনুল খান ইনকিলাবকে বলেন, প্রতি মাসে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। সকল যাত্রীকে তল্লাশি করা সম্ভব নয়। সোনা চোরাচালানের সাথে এক বা দু’জন জড়িত নয়। নেপথ্যে অনেকে রয়েছে। আমরা নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে তল্লাশি চালিয়ে সোনার চালান আটক করি। তবে তিনি স্বীকার করেন যে তথ্যের আড়ালেও সোনা চোরাচালান হচ্ছে। চিকিৎসা, পড়াশুনা কিংবা বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে সোনার বার নিয়ে আসার ঘটনা অহরহ ঘটছে। কাস্টমস হলে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা (সিসিটিভি) দিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ফলে তথ্যের আড়ালে চোরাচালানের ঘটনা প্রায়ই ধরা পড়ে।

এক প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, কাস্টমস সোনা চোরাচালানের ঘটনায় জড়িতদের তাৎক্ষণিকভাবে অর্থদ- দিচ্ছে। ঘটনার তদন্ত এবং নেপথ্যে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টি পুলিশের। একাধিকবার বিমানবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সোনার বারসহ আটক করা হয়েছে। এখান থেকেই অনুমেয়, পাচারের সাথে জড়িতদের কোন ছাড় দেয়া হয় না। তিনি আরো জানান, গত বছরের ১ জুলাই থেকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমস প্রায় ১৭ মণ সোনার বার উদ্ধার করেছে। আর চোরাচালানের সাথে জড়িত ৭৮ জনকে আটক করে পুলিশের হাতে সাপর্দ করা হয়েছে।

বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সিনিয়র এএসপি মো. আলমগীর হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, ১১৬ গ্রাম ওজনের প্রতিটি সোনার বারের জন্য এক হাজার ৩৫০ টাকা ট্যাক্স ছিলো। আর এ সুযোগের পুরোটাই ব্যবহার করেছে চোরাচালানি চক্র। গত বছরের জুনের আগে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি ফ্লাইটে কমপক্ষে ৪০ জন যাত্রীর কাছে থাকতো ২টি করে ৮০টি সোনার বার। এভাবে ট্যাক্স দিয়ে দিনে ৭০ থেকে ৮০ কেজি সোনার বার নিয়ে আসার ঘটনায় গোয়েন্দা অনুসন্ধান শুরু হয়। গত বছরের জুনের পর থেকে ১১৬ গ্রাম ওজনের দুইটি সোনার বারের জন্য নতুন করে ৫৪ হাজার ট্যাক্স নির্ধারণ করা হলে চোরাচালানীরা কৌশল পাল্টে ফেলে।

প্রায়ই ধরা পড়লেও থামছে না সোনার চোরাচালান। দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বিমানবন্দর ছাড়া অন্য কোথাও সোনার চালান ধরা পড়ার কথা নয়। আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশনে ধরা পড়ার অর্থই হচ্ছে চক্র কৌশল পরিবর্তন করছে। ঢাকায় না পারলে চক্রটি চট্টগ্রাম ও সিলেটকে ব্যবহার করে। তিনি আরো বলেন, সোনার বড় বাজার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। চোরাচালানিরা দিল্লি ও কলকাতাকে ব্যবহার করতে না পেরে ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে। বেসরকারিভাবে ভারতে সোনা আমদানি বাতিল করার পর থেকে চক্রগুলো বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকেছে।

এদিকে জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি ডা. দীলিপ রায়ের কথা, চোরাচালান হয়ে আসা সোনার বারের খুব অল্প পরিমাণে বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে। বেশিরভাগই চলে যায় ভারতসহ প্রতিবেশী অন্যান্য দেশে। চোরাচালানিরা বাংলাদেশকে শুধুমাত্র ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, রাজধানীতেই ছোট-বড় মিলিয়ে এক হাজার ২০০ জুয়েলারির দোকান রয়েছে। রাজধানীসহ সারাদেশে দিনে আড়াই হাজার ভরি সোনা অর্থাৎ ১০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। বিমানবন্দরে একদিনে যে পরিমাণ ধরা পড়ে তা দিয়ে সারাদেশের এক মাস চলবে।

যারা বৈধপথে বিদেশ থেকে সোনার বার ও অলংকার নিয়ে আসে তা জুয়েলারিতে কিনে রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিলামে কেনা ছাড়াও রিসাইক্লিং-এর মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করা হয়। আর কিছুটা আসে প্রবাসী বা বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে। তিনি বলেন, জুয়েলারি সমিতির সদস্য কেউই সোনা চোরাচালানের সাথে জড়িত নয়। এর পিছনে বড় বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। রাঘব বোয়ালরা হাজার হাজার কোটি টাকা চোরাচালানে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বিমানবন্দরে যারা ধরা পড়ছে তারা হচ্ছে বহনকারী। রাঘব বোয়ালার থেকে যায় ধরাঁ ছোয়ার বাইরে।

– সাকির আহমদ

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.