হয়রানি উৎকোচ আর চুরি ছাড়া পণ্য খালাস হয় না

477493মঙ্গলবার সকাল ১০টা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্স। কমপ্লেক্সের বারান্দাজুড়ে মালামালের ছড়াছড়ি। ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। তবু অবাধে ঢুকছেন বহিরাগতরা। বারান্দার একদিকে হঠাৎ একটি জটলা দেখা গেল। একজন ব্যবসায়ীর চিত্কার-চেঁচামেচি। জানা গেল, নয় দিন আগে এই ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে কোটি টাকা মূল্যের গার্মেন্ট পণ্য আমদানি করেছিলেন। কিন্তু বিমান ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তার সেই মাল খুঁজে পাচ্ছে না।

মফিদুল নামে ভুক্তভোগী ওই গার্মেন্ট ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, ইদানীং তার মতো অনেকেরই এভাবে মালামাল চুরি যাচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়ছেন আমদানিকারকরা। কেবল চুরি যাওয়া নয়, আমদানিকারকদের পকেট কাটতে কাস্টমসের এমন অনেক ফন্দি-ফিকিরের কথাই জানান তিনি। সেই সঙ্গে আছে বিমানের অব্যবস্থাপনা, লোডার সংকট ও জায়গা সংকুলানের অভাব।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারও ক্ষেত্রে নিয়মের কথা বলে আবার কারও ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনের বালাই না মেনেই নিজেদের ইচ্ছামতো শুল্ক বিল তৈরি করে মালামাল খালাস করছে বিমানবন্দর কাস্টমস। অভিযোগ রয়েছে, আকাশপথে আসা এসব কার্গো মালামাল খালাসের ক্ষেত্রে উেকাচ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। নিয়ম মেনে শুল্ক পরিশোধের মাধ্যমে মালামাল খালাস করতে চাইলেও পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের। বছরের পর বছর ধরে পুরো বিমানবন্দর ও কাস্টমস জুড়ে অবৈধ সিন্ডিকেটের কারণে সেখানে বৈধ পন্থায় কাস্টমস পার হওয়াই যেন দুষ্কর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কাস্টমসের সবচেয়ে বড় কারসাজি হচ্ছে মালামালের ক্যাটাগরি নির্ধারণে। নিয়ম অনুযায়ী আমদানিকৃত দ্রব্যের ধরন অনুসারে শুল্ক আরোপের কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না। দ্রব্যের ধরন ও সে অনুযায়ী শুল্ক আদায়ে অসদুপায় অবলম্বন করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে উচ্চ শুল্কসম্পন্ন কোনো একটি দ্রব্যকে নিম্ন শুল্কসম্পন্ন দ্রব্যের ক্যাটাগরিতে ফেলে ইচ্ছামতো বিল করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। এতে ওই ব্যবসায়ীর কোটি কোটি টাকা বেঁচে যায়। বিনিময়ে বড় একটি অ্যামাউন্টের উেকাচ পান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এতে ব্যবসায়ী নিজেও যেমন লাভবান হন, তেমন অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের হয় পোয়াবারো। মাঝখানে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারায় সরকার। কার্গো ভিলেজের সামনে শহিদুল নামে এক ব্যবসায়ী এজেন্ট তার পণ্য খালাসের কাগজপত্র দেখিয়ে বলেন, ‘দেখেন, ২০-২৫ টেবিল পার হয়ে ছাড় নিয়ে এলাম। সবখানে অতিরিক্ত টাকা ঢালতে হলো।’

এদিকে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা সত্ত্বেও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। সরেজমিনে দেখা যায়, অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন লোকজন। রয়েছে দালালের উত্পাতও। দালালরা ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (ডিসিএএ) নাম ভাঙিয়ে ব্যবসায়ীদের পকেট কাটলেও দেখার যেন কেউ নেই। এসব চক্রের অধিকাংশের নেপথ্যে রয়েছেন বিমানবন্দর-সংশ্লিষ্ট ১৮টি সংস্থার কোনো না কোনো কর্মকর্তা। সম্প্রতি বিমানবন্দরে সরকারের ‘কঠোর নিরাপত্তা’ সত্ত্বেও সক্রিয় রয়েছে চোরাচালান সিন্ডিকেট। কাস্টমস বিভাগের বড় একটি অংশই এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে সোনা চোরাচালানের ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে কাস্টমস বিভাগ জানায়, ২০০৯ সালের নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কেজি সোনা উদ্ধার করে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছেন তারা। সম্প্রতি আবার বেড়ে গেছে ভারতীয় মুদ্রা পাচার। গোয়েন্দা তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক এসব চক্রকে সহযোগিতা করছে বিমানবন্দরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটগুলোই। সম্প্রতি এ সিন্ডিকেটের সংখ্যা এতই বেড়ে গেছে যে, তাদের নিজেদের মধ্যেই সারাক্ষণ প্রতিযোগিতা চলছে। সেই সুবাদে তথ্য পাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আর সে কারণেই ধরা পড়ছে বিভিন্ন চক্র। একজন ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, চলতি মাসের শুরুতে বিমানবন্দর এলাকায় তার প্রায় দেড় কোটি মূল্যের পণ্য ছিনতাই হয়েছে। থানায় মামলা করেও কোনো সুরাহা পাননি তিনি। তার অভিযোগ, বিমানবন্দর সিন্ডিকেটের সদস্যদের তথ্যের ভিত্তিতে এসব ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।

সার্বিক অব্যবস্থাপনা বিষয়ে কার্গো টার্মিনালের ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার নাসির উদ্দিন তালুকদারের কাছে জানতে চাইলেও তিনি মুখ খোলেননি। একইভাবে মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকার কথা বলে কথা বলতে রাজি হননি বিমানের জিএম আলী আহসান বাবু। তবে কাস্টমস কমিশনার লুত্ফর রহমান বলেন, ‘আমাদের দ্বারা কেউ হয়রানি হচ্ছেন না। বিমান বা অন্য কোনো সংস্থার দ্বারা কেউ হয়রানি হয়ে থাকলে তার জন্য আমরা দায়ী নই।’ আর নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলেও তিনি জানান।

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.