এভিয়েশন নিউজ: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বাতাসে টাকা ওড়ে! একটু চোখ-কান খোলা রেখে কিছু লোককে ম্যানেজ করতে পারলেই অনায়াসে এ টাকা হাতের মুঠোয় চলে আসে। আর বিষয়টা এতোটাই লোভনীয় যে, পদ-পদবীর মর্যাদা ভুলে অনেকেই এ টাকা ‘কুড়াতে’ নেমে পড়েন। সাধারণত হেরোইন, স্বর্ণ, মুদ্রা, সিগারেট ও আদম পাচারে সহায়তা এবং লাগেজ চুরি ও যাত্রীদের হয়রানির মাধ্যমে এই অবৈধ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়।
তবে এসব কাজ করতে গিয়ে ধরাও পড়েন অনেকে। আটকদের তালিকায় বিমান, কাস্টমস, ব্যাংক, সিবিএ, এয়ারলাইন্স, পরিবহন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে রয়েছে পরিচ্ছন্নকর্মী, দালাল, পকেটমার এবং প্রতারক চক্র। বিমান বন্দরে দায়িত্বপালনকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পুলিশের রেকর্ড থেকে জানা যায়, দেশের সর্ববৃহত্ এই বিমান বন্দরে গত চার বছরে (জুন ২০১০-অক্টোবর ২০১৪) বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে আর্মড পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ৩ হাজার ৫৪০ জন। এ সময় পাচারকালে উদ্ধার হয়েছে ১১২ কেজি স্বর্ণ, দশ হাজার ৯২৪ কার্টন সিগারেট, ১৬ কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ও সোয়া ১৬ কেজি হেরোইন।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন এ বিমান বন্দর থেকে ওঠা-নামা করে ১২০ থেকে ১৩০টি ফ্লাইট। যাত্রীর সংখ্যা হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার। আর যাত্রীদের বিদায় ও অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হন আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ। বছরে গড়ে ৫০ লাখ মানুষ এ বিমান বন্দর দিয়ে আসা-যাওয়া করেন। তবে বখশিশ, লাগেজ চুরিসহ নানাভাবে যাত্রীদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া সক্রিয় রয়েছে দালাল, পকেটমার ও প্রতারক চক্র। তেমনি রয়েছে স্বর্ণ, মুদ্রা ও সিগারেট চোরাচালানি সিন্ডিকেট। এসব নানা অবৈধ কাজে প্রতিদিন বিমান বন্দরে লাখ টাকা লেনদেন হয় বলে একটি সূত্রের দাবি।
বিমান বন্দরে অপরাধের ধরন সম্পর্কে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সিনিয়র এএসপি আলমগীর হোসেন শিমুল ইত্তেফাককে বলেন, বিমান বন্দরে অপরাধের ধরন খুবই বিচিত্র। যে যেভাবে টাকা কামাতে পারে সেই দিকেই তার নজর। কেউ আদায় করে যাত্রীর কাছ থেকে, কেউ টাকা কামায় মালামাল পাচার করে, কেউ কাটে লাগেজ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য থেকে টয়লেটের কর্মী পর্যন্ত এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। অবৈধ পথে টাকা কামাইয়ের ক্ষেত্রে সবাই একই কাতারে।
অবশ্য পুলিশের এ কর্মকর্তা দাবি করেন, আর্মড পুলিশের কঠোর নজরদারির কারণে বিমান বন্দরে দৃশ্যমান অপরাধীদের দৌরাত্ম্য অনেকাংশে কমেছে। তবে অদৃশ্য চোরাচালানী সিন্ডিকেটের তত্পরতা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। হয়তো এ জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে।
জানা গেছে, বিমান বন্দরে যাত্রীদের লাগেজ স্ক্যানিং করে কাস্টমস। তাদের একটি মাত্র স্ক্যানার। এ কারণে সব লাগেজ স্ক্যান করা সম্ভব হয় না। যেগুলো সন্দেহ হয় সেগুলোই স্ক্যান করা হয়। এছাড়া সব যাত্রীকে ‘আর্চওয়ে’র (বিশেষ পথ) মধ্যে আনা হয় না। এসব কারণে অবৈধ দ্রব্যাদি সহজেই পাচার হয়ে যায়। আলমগীর হোসেন শিমুল প্রতিবেশী একটি দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে বিমান বন্দরগুলোতে শতভাগ যাত্রীর লাগেজ স্ক্যান ও তল্লাশীর ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে স্বর্ণ পাচারের মত কোন ঘটনা সেখানে নেই।
বিমান বন্দর থানার অফিসার ইনচার্জ শাহ আলম বলেন, বিমান বন্দরে বর্তমানে যাত্রী হয়রানি, পরিবহন কর্মীদের টানাটানি, ছিনতাই, প্রতারণা ইত্যাদি দৃশ্যমান অপরাধ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। তবে চোরাচালান পুলিশ চাইলেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তবে পুলিশ জানতে পারলে তাত্ক্ষণিক এসব অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
গ্রেফতার চিত্র:
জানা গেছে, শাহজালাল বিমান বন্দরে ২০১০ এর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৯৬ জন, ২০১১ সালে ৫৩১ জন, ২০১২ সালে ৮৬৭ জন, ২০১৩ সালে ১ হাজার ৩১৯ জন এবং ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ৪২৭ জনকে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রী হয়রানিকারী ৫০৩ জন, অবৈধ মুদ্রা ব্যবসায়ী ১৪৮, মালামাল পাচারকারী ৮৯, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ৪৭০ জন, বিমান কর্মী ৪৭, কাস্টমস সদস্য ৩, হকার-পোর্টার ৩১১, মানব পাচারকারী ২৯, জাল পাসপোর্টধারী ৬৮৯, রোহিঙ্গা ১১৭, মালামাল চোর ২৭৩, ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ-পকেটমার ৮৪, লাগেজ কাটা চোর ৬৩, অস্ত্রধারী ৩, প্রতারক ১৩, দালাল ২২৪, মাদক ব্যবসায়ী ৬, ভুয়া পরিচয়দানকারী ১৫, সিএবি সদস্য ৩৫, আনসার সদস্য ৯, পরিবহন কর্মী ৪৩, ব্যাংক কর্মচারী ৭, এয়ারলাইন্সের সদস্য ৮, হেল্পডেস্কের সদস্য ৪, টয়লেটের পরিচ্ছন্নকর্মী ২৬ ও বিমান বন্দরে দায়িত্বপালনকারী অন্যান্য সংস্থার ১৪৮ জন রয়েছে।