লকডাউনে মানবেতর পরিস্থিতিতে সিঙ্গাপুরের অভিবাসী শ্রমিক

বাণিজ্যনগরী সিঙ্গাপুরের রেস্টুরেন্ট ও শপিংমলগুলো খোলার সঙ্গে সঙ্গে মহামারীপূর্ব সময়ের কার্যক্রম ফিরে এসেছে। মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে, বাইরে খাচ্ছে এবং শপিংমলে কেনাকাটা করছে। কিন্তু তিন লাখেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিকের কাহিনীটা ভিন্ন। তাদের খেয়েদেয়ে বাসাভাড়া দিয়ে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। খবর ব্লুমবার্গ।

গত এপ্রিল থেকে তারা নিজেদের বাসাবাড়িতে আটকা পড়ে রয়েছে। কাজের জন্য সীমিত পরিসরে বের হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিস্তৃত পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিন কর্মসূচির পর আগস্টের পর থেকে ওই ডরমিটরিগুলো থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হচ্ছে।

গত মাসে সরকার জানায়, তারা অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য নীতিমালা আরো শিথিল করতে যাচ্ছে। তবে শ্রমিকদের আবাসস্থলে নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধিতে ওই পরিকল্পনা হুমকিতে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ থেকে আসা মোহাম্মদ আল ইমরান নামে এক শ্রমিক বলেন, অনেক দিন আমার খুব কষ্ট লাগে এবং তা মেনে নিতে পারি না।

জনাকীর্ণ হোস্টেলগুলোয় মাসের পর মাস অবস্থান করে নিজেও কভিড-১৯-এ সংক্রমিত হয়ে পড়েন। তাকে তখন একটি নভেল করোনাভাইরাস কেয়ার ফ্যাসিলিটিতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। ওখানে অবস্থানকালে তুলনামূলকভাবে বেশি স্বাধীনতা উপভোগ করেছেন ইমরান। হোস্টেলে আপনি নিজের কক্ষ থেকেও বের হতে পারবেন না। একটি টেক্সট মেসেজে তিনি আরো লেখেন, তারা হোস্টেলগুলোকে কয়েদখানার মতো ব্যবহার করছে।

সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা যথাযথ পদক্ষেপই গ্রহণ করেছে। বাণিজ্যনগরীটির মোট কভিড-১৯ আক্রান্তের ৯৫ শতাংশই অভিবাসী শ্রমিক। নভেল করোনাভাইরাসমুক্ত ঘোষণার অল্প কয়েক দিন পরই নতুন করে হোস্টেল ও ডরমিটরিগুলোয় সংক্রমণের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে সরকারের এ নীতির কারণেই কি সংক্রমণ বাড়ছে?

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি মেডিকেল স্কুলের অধ্যাপক ও সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ পিটার কলিগনন বলেন, তুলনামূলকভাবে আর্থসামাজিকভাবে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আপনি যদি জনাকীর্ণ জায়গায় আটকে রাখেন তাহলে উচ্চহারে কভিড ১৯ সংক্রমণ ঘটবেই। অতিঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে ভিন্নভাবে দেখা অযথার্থ নয়, তবে তাদের ওপর অতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা অযৌক্তিক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো প্রাদুর্ভাব এড়াতে বিশেষ কিছু অঞ্চল কর্ডন করে দেয়া অযৌক্তিক নয়। তবে ওই হোস্টেল ও ডরমিটরিগুলোর অবস্থাও ভবিষ্যৎ সংক্রমণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সেখানকার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা ভালো নয় এবং একই বাথরুম ব্যবহার করছে এক ডজন বা তারও বেশি মানুষ।

বৈশ্বিক এ মহামারীতে সবচেয়ে ধাক্কা খেয়েছে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষগুলো। ভালো সময়েও নাগরিক ও হোয়াইট কলার প্রবাসীদের চেয়ে অধিক বিধিনিষেধের মধ্যে বসবাস করে এসেছেন সিঙ্গাপুরের অভিবাসী শ্রমিকরা। প্রলম্বিত লকডাউনে থাকার কারণে অভিবাসী শ্রমিকরা মানসিক চাপে থাকার পাশাপাশি ওই ডরমিটরি ও হোস্টেলগুলোয় নতুন করে সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে।

স্থানীয় গণমাধ্যম ও ফেসবুকে বলা হচ্ছে, অনেক অভিবাসী শ্রমিক আত্মঃক্ষতি ও আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন। সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এদের অনেকেই আগে থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছেন বা তাদের দেশের বাড়িতে সমস্যা চলছে। অবশ্য স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ভিন্ন কথা বলছে।

ট্রানজিয়েন্ট ওয়ার্কার্স কাউন্ট টু নামে এক সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালেক্স অউ বলেন, গত দুই মাসে পরিস্থিতি অবশ্যই আরো খারাপ হয়েছে। অভিবাসী শ্রমিকদের কথার স্বর পরিবর্তন হয়ে গেছে। অনেকেই বলছে, দরকার নেই আমার বেতনের। এখান থেকে আমাকে বের করার ব্যবস্থা করেন। আমি দেশে যেতে চাই।

ওভারটাইমসহ একজন অভিবাসী শ্রমিক ৬০০ থেকে ১ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার আয় করতে পারতেন। এর বড় একটা অংশ চলে যায় বাসাভাড়ায়। কোনো ডরমিটরিতে গাদাগাদি করা রুমে একটি বিছানার জন্য তাদের দিতে হয় ৩৫০ সিঙ্গাপুর ডলার। একই রুমে দেখা গেছে ১২ থেকে ১৬ জনকে থাকতে হয়।

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় গত জুন নাগাদ ৩২ হাজারেরও বেশি শ্রমিককে সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। দীর্ঘমেয়াদে ১১টি নতুন ডরমিটরি তৈরি করতে যাচ্ছে। তখন প্রতি কক্ষে সিঙ্গেল বেডের সংখ্যা ১০টির বেশি রাখা যাবে না। বর্তমানে প্রতি ১৫ জনে যেখানে একটি বাথরুম, টয়লেট ও বেসিন ব্যবহার করছে, তখন সেটা প্রতি পাঁচজনের জন্য একটি করা হবে।

তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা শ্রমিকদের জন্য অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বব বু নামে এক চীনা শ্রমিক বলেন, ডরমিটরির অসহনীয় পরিবেশের কারণে আমি ঘুমাতে পারছি না এবং গভীর মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছি।

কোরি হোল্ডিংস নামে একটি নির্মাণ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুই ইয়ু কোহকে প্রায় ২০০ অভিবাসী শ্রমিক জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা কাজ করতে চাইছেন না এবং দেশে ফেরত যেতে চান।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.