ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই ফোরাম ইনকের (ডুয়াফি) আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হয়েছে ওয়াশিংটনপ্রবাসী লেখক ড. সৈয়দ আশরাফ আহমেদের দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার সুধী সমাজের প্রায় এক শ মানুষের উপস্থিতিতে অত্যন্ত চমৎকার আয়োজনে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এই মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। ১ মে রোববার মেরিল্যান্ডের কেবিন জন মিডল স্কুলের মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
উল্লেখ্য, ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকায় অন্যান্য আয়োজনের পাশাপাশি ডুয়াফির এই আয়োজনটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার। ভিন্ন আঙ্গিকে আয়োজিত ও উপস্থাপিত একটি নান্দনিক অনুষ্ঠান। যার মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনপ্রবাসী সাহিত্যানুরাগী বাঙালিদের বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। সেই সঙ্গে এই এলাকার প্রবাসী কবি-সাহিত্যিক ও তাদের সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টির স্বীকৃতি প্রদান ও অভিনন্দন জ্ঞাপনের জন্য প্রকাশ পেয়েছে এক অনন্য মননশীলতা।
ডুয়াফি যে দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের জন্য এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সেই বই দুটি হলো আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত মার্তি মনীষের প্রেতাত্মা (প্রকাশকাল ২০১৬) ও অন্য চোখে বাংলাদেশ (প্রকাশকাল ২০১৫)। প্রথম বই লেখকের পর্তুগালে ভ্রমণ অভিজ্ঞতার ওপর লিখিত। এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার অন্তরালে তিনি বিচরণ করেছেন পর্তুগালের হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের পাতায়। সেই প্রাচীন ইতিহাসকে তুলে আনতে গিয়ে তিনি কাল্পনিক ঘটনার আশ্রয়ে সমসাময়িক জীবনধারার সঙ্গে একটি মেলবন্ধন গেঁথে দিয়ে সৃষ্টি করেছেন একটি অনুপম কাহিনি। দ্বিতীয় বইয়ে চার দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, বহমান জীবনধারা ও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মানসিকতায় যে ব্যাপক পরিবর্তন লেখক অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে লক্ষ্য করেছেন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দৃশ্যএই বই দুটি ছাড়াও লেখকের আরও দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে। জলপরি ও প্রাণপ্রভা (আগামী প্রকাশনী, প্রকাশকাল ২০১৪) ও কলাচ্ছলে বলা (আগামী প্রকাশনী, প্রকাশকাল ২০১৩)।
অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছিল কয়েকটি পর্বে। লেখক ড. আশরাফ আহমেদের ব্যক্তি জীবনের ওপর আলোকপাত ও ভিডিওচিত্র প্রদর্শনী, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার গুণীজনদের সান্নিধ্যে লেখক ও প্রকাশিত উপন্যাসের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠান, মার্তি মনীষ থেকে নেওয়া বাংলা পর্তুগিজ ফাদো গান পরিবেশনা, ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকা থেকে ডুয়াফির তিন সদস্যের সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই থেকে কবিতা আবৃত্তি, লেখকের সঙ্গে আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বের একটি ভিন্ন সাহিত্য আড্ডা এবং প্রকাশিত বইভিত্তিক জারি গান।
শুরুতেই খুদে শিল্পী লাবিবা রহমান ভায়োলিনে জাতীয় সংগীতের সুর বাজিয়ে শোনায়। এ সময় সকলে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এরপর লেখক ড. আশরাফ আহমেদের ব্যক্তি জীবনের ওপর নির্মিত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। ভিডিওচিত্রটি নির্মাণ করেছেন ডুয়াফির সদস্য শফিকুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দৃশ্যঅতঃপর ডুয়াফির সভাপতি ড. মিজানুর রহমান সংগঠনের পক্ষ থেকে সবাইকে অনুষ্ঠানে স্বাগতম ও শুভেচ্ছা জানান। এরপর বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করেন ড. মিজানুর রহমান, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, সাবেক আমলা ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন চৌধুরী, সাবেক আমলা ও লেখক আজিজুল জলিল, সাবেক নাট্যকার, চলচ্চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিক কাফি খান ও সাবেক সাংবাদিক সৈয়দ জিয়াউর রহমান।
মোড়ক উন্মোচনের পর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ত্রৈমাসিক সাউথ এশিয়া ফোরামের সম্পাদক-প্রকাশক ড. মোহসিন সিদ্দিকী, চিকিৎসক ও লেখক সৈয়দ মাহতাব আহমেদ, অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলস ও ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের সাবেক অধ্যাপক ড. হাসান ইমাম, বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. সুলতান আহমেদ, সফটওয়্যার প্রকৌশলী, নর্দার্ন ভার্জিনিয়ার ডেমোক্রেটিক পার্টি ও এএআরপির সক্রিয় সদস্য, পুস্তক সমালোচক ও কলামিস্ট ওয়াহেদ হোসেইনী, বিবিসির সাবেক ও ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের বর্তমান সংবাদ বিশ্লেষক, পাঠক, কলামিস্ট ও কবি আনিস আহমেদ ও বুয়েটের সাবেক শিক্ষক, ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক, লেখক ও স্থাপত্য গবেষক আদনান মোর্শেদ।
আলোচকেরা আশরাফ আহমেদের ব্যক্তি জীবন, তার ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা, পেশাগত সম্পৃক্ততা ও তার সাহিত্য সৃষ্টির ওপর আলোচনা ও পর্যালোচনাসহ বিশদ আলোকপাত করেন এবং তার সদ্য প্রকাশিত বইয়ের ওপর আলোচনা করে বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দৃশ্যআলোচনার পর ড. আশরাফ আহমেদের সদ্য প্রকাশিত উপন্যাস মার্তি মনীষের প্রেতাত্মা থেকে ফাদো গান পরিবেশন করেন রাজিয়া সুলতানা। এটা অনেকটা বাংলাদেশের ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া গানের আদলে রচিত ও গীত। কিছুটা বিষাদময় ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ফাদো গানে। এরপর শুরু হয় ডুয়াফির তিন সদস্যের সদ্য প্রকাশিত কবিতার বই থেকে নেওয়া কবিতার আবৃত্তি। যেসব কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতাগুলো নির্বাচন করা হয়, তা হলো—জলরাশির জন্য বাক্যসমূহ, জসীম উদ্দিন গওহর। বিম্বিত কার্তিকডাঙ্গায়, মোহাম্মদ তারেক। আলোকিত পালকের জলবিন্দু, আনিস আহমেদ। কবিতা আবৃত্তিতে অংশগ্রহণ করেন দিনা, মেরী, মিতা ও সোমা। তাদের চমৎকার আবৃত্তি সবাইকে মোহিত করে।
আবৃত্তির পর পরই মঞ্চে আসেন শফি দেলোয়ার কাজল। তার গ্রন্থনা ও উপস্থাপনায় দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা, সাহিত্য আড্ডা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব পরিচালিত হয়। লেখকের সঙ্গে এই সাহিত্য আড্ডায় অংশগ্রহণ করেন দস্তগীর জাহাঙ্গীর, জাহিদ মণ্ডল, এ্যান্থনী পিউস গমেজ, সন্তোষ বড়ুয়া ও ড. ইউনুস ঠাকুর। অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিল অনুষ্ঠানের এই পর্বটি। লেখককে সরাসরি প্রশ্ন করার সুযোগ অংশগ্রহণকারীরা লেখককে সাহিত্য ও জীবনভিত্তিক প্রশ্ন করে তার ব্যক্তি ও লেখক সত্তার ভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করেন।
এ পর্বের পর শুরু হয় জারি গান। প্রকাশিত উপন্যাস মার্তি মনীষের প্রেতাত্মা ও লেখককে লক্ষ্য করে জারি গান পরিবেশন করেন শফিকুল ইসলাম, কণ্ঠ শ্রমিক কাইউম খান, মোহাম্মদ আবির আবসার, আনন্দ ও পল গোমেজ। অত্যন্ত চমৎকার পরিবেশনা ছিল এই জারি গান।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন দৃশ্যঅবশেষে ডুয়াফির সভাপতি মিজানুর রহমান অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান ও সবার মঙ্গল কামনা করেন। এরপর তিনি অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানার জন্য লেখক আশরাফ আহমেদকে অনুরোধ করেন। আশরাফ আহমেদ সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
অনুষ্ঠানের পর দেখে যায় অনেকেই আশরাফ আহমেদের কাছে হাজির হয়েছেন তাদের সংগৃহীত বইয়ে তার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। তাকে নিয়ে ছবি তুলে মুহূর্তের স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন কেউ কেউ।
এক সময় শেষ হয় ডুয়াফির আয়োজনে ড. আশরাফ আহমেদের প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের নান্দনিক অনুষ্ঠানটি। অনেক অনুষ্ঠানের স্মৃতির ভিড়ে এ অনুষ্ঠানটি একটি ভিন্ন আবেদন নিয়ে মনের গভীরে থেকে যাবে বহুদিন। মনে থাকবে ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার কিছু আলোকিত মানুষদের সান্নিধ্যে কেটে যাওয়া এই সুন্দর দিনটির কথা। কখনো কখনো পেছন ফিরে তাকালে মনে পড়ে যাবে মননশীল এই আয়োজনটির কথা, মনটা আপ্লুত হয়ে উঠবে এই সব আলোকিত মানুষের ভিড়ে কেটে যাওয়া কিছু সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতির ছোঁয়ায়।