মাঈনুল ইসলাম নাসিম, এভিয়েশন নিউজ: বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি হয় বলে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না দিয়ে সবক’টি মন্ত্রণালয়ে তালা ঝুলিয়ে রাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্ম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ন্যাস্ত করার প্রস্তাব করলে কেমন হয় ? বাংলাদেশ সরকারের জনশক্তি রপ্তানী নীতিমালার ক্ষেত্রে কিন্তু তাই হয়েছে। কতিপয় অসাধু রিক্রুটিং এজেন্ট যারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিরীহ মানুষকে ঠকিয়েছে, তাদেরকে আইনের আওতায় না এনে তথা শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে না পেরে সরকার বেছে নেয় আত্মঘাতী জি-টু-জি পলিসি।
সরকার-টু-সরকার (জি-টু-জি) চালু হবার আগে ২০১২ সালে যেখানে বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন সেখানে ‘মরণ পলিসি’ জি-টু-জি’র খেসারতে ২০১৩ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৪০৯ জনে নেমে আসে। অর্থাৎ ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে জনশক্তি রপ্তানি কমে যায় শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি। জনশক্তি রপ্তানীর এই ধ্বংসাত্মক ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল ২০১৪ সালেও। ফলশ্রুতিতে আশংকাজনক হারে বেড়েছে অবৈধভাবে সাগরপাড়ি দেবার ভয়াবহ প্রবণতা।
‘জি-টু-জি’র মতো সরকারের ভুল পলিসি, সেই সাথে প্রভাবশালী মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেনের চরম একগুয়েমি সব মিলেমিশে একাকার হয়েই জণশক্তি রপ্তানির এই মহাধ্বস। মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ ‘দৃশ্যমান’ ক্ষমতার জোরে জবাবদিহিতা ও ধরাছোঁয়ার এতোটাই উর্ধে যে, কারো কোন পরামর্শের ধার ধারেননা বলে অভিযোগ বহুদিনের। ‘নো রিক্রুটিং এজেন্ট’ অর্থাৎ শুধুমাত্র সরকারীভাবে বিদেশে কর্মী প্রেরণ করা হবে এমন জি-টু-জি ফর্মুলা চাপিয়ে দেবার মুহূর্তে ২০১৩ সালের গোড়ার দিকে সারা বাংলাদেশ জুড়ে জেলায় জেলায় সরকারীভাবে ঝুলানো হয়েছিল প্রলোভনের মূলা।
দেশের দরিদ্র জনগনকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় মাত্র ৩৩ হাজার টাকায় মালয়েশিয়া যাবার সুযোগ করে দেবার। এই প্রক্রিয়ায় তখন গোটা দেশের ১৪ লাখ ৪২ হাজার ৭৭৬ জন নাম নিবন্ধন করেন বিদেশ যাবার স্বপ্নে। ৭ দিনের ঐ নিবন্ধন ধুমধামে তখন রাষ্ট্রের প্রায় ৭ কোটি টাকা জলে গেলেও কাজের কাজ আজ অবধি কিছুই হয়নি। মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ বারবার জাতিকে বেহুদাই সুসংবাদ দিয়েছেন। বছরে ১ লাখ লোক যাবে মালয়েশিয়াতে এমনটা সরকারের তরফ থেকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হলেও জি-টু-জি চালু হবার গত ১৯ মাসে মালয়েশিয়া গিয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ৩৪০ কর্মী।
প্রবাসী কল্যান ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের ভেতরের লোকজনই বলছেন, মন্ত্রী খোন্দকার মোশাররফ হোসেনের একগুয়েমির কারণেই মূলতঃ মালয়েশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংস হয়েছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। কারণ বাংলাদেশ সরকারের চাপিয়ে দেয়া ‘জি-টু-জি’ পলিসি নিয়ে মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কোন সরকারেরই কিন্তু ন্যূনতম কোন মাথাব্যথা নেই। বিভিন্ন দেশের রিক্রুটিং কোম্পানিগুলোই শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের বিশাল শ্রমবাজার।
জি-টু-জি নীতিমালা প্রবর্তনের আগে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যখন উভয় দেশে বাংলাদেশি কর্মীদের যাবার সুযোগ ছিলো, তখন বাংলাদেশি এজেন্সিগুলোর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিয়োগদাতা কোম্পানিগুলোও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারতো। সব কিছুই চলে আসছিলো একটি সহনীয় সিস্টেমের মধ্য দিয়ে। অসাধু দালাল-সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হলেও সফলতা দেখায় বাস্তবতাবর্জিত অযৌক্তিক গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি) পলিসি চাপিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে।
রিক্রুটিং এজেন্সি গোল্লায় যাবে, সরকারের সাথে সরকারের চুক্তি হবে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে, মূলতঃ এরই নাম ‘জি-টু-জি’। মজার ব্যাপার হচ্ছে, খুব দ্রুতই হিতে বিপরীত হয় সরকারের আত্মঘাতী এই নীতিমালা। জি-টু-জি পলিসির কারণে বাড়তি লাভবান হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উক্ত দেশগুলোর নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো চরমভাবে নাখোশ হয় বাংলাদেশ সরকারের ওপর, যা দিনকে দিন কমেনি বরং বেড়েছে। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জি-টু-জি)’র বাধ্যবাধকতার কারণে বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বহুদিনের অভ্যস্ততা তথা বাড়তি বেনিফিট থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের কপোলে।
কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কমানোর নামে রিক্রুটিং এজেন্সির রুটি-রুজি বন্ধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া ‘জি-টু-জি’ ফর্মূলা যে শতভাগ ভুল ছিল, তা দেশে-বিদেশে আজ দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় কর্তৃক বিদেশে কর্মের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টিতে বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক সব সময়পোযোগি পদক্ষেপ নেয়াই ছিল যেখানে মূখ্য কাজ, কিন্তু তা না করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর চরম একগুয়েমি ও মন্ত্রণালয় কর্তৃক বাস্তবতা বিবর্জিত নীতিমালার খেসারতে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
‘জি-টু-জি’ পলিসিতে আজ মালয়েশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে বাংলাদেশের বিশাল শ্রমবাজার, বন্ধ হয়েছে সব দুয়ার। জি-টু-জি বহাল রেখে বাংলাদেশের যে কোন সরকারপ্রধাণ যদি ১০ বার আমিরাত কিংবা ২০ বার মালয়েশিয়া সফরও করেন, তারপরও শ্রমবাজারের তালাবদ্ধ দুয়ার খোলার আদৌ সুযোগ নেই, এই সহজ সত্যটি মেনে নিতে কেন এতো কালক্ষেপণ ? মোদ্দাকথা জি-টু-জি ইন বাংলাদেশ আউট। দুবাইর পর এবার কুয়ালালামপুর ঘুরে এসেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যথারীতি বলেছেন সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও কার্যকর হয়েছে। বিজয়ের মাসে সত্যের কেন এই কৃত্তিম অপমৃত্যু?