মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু নির্যাতনের ভয়ে কর্মীরা এসব দেশে কাজ করতে যেতে আগ্রহী নন। গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী কর্মী নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন। ভয় কাটাতে সঙ্গে পুরুষ আত্মীয় পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলেও তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে নারী কর্মী গমন গত বছরের তুলনায় নিম্নমুখী।
মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, জর্ডান ও লেবানন বাংলাদেশের নারী কর্মীদের
প্রধান গন্তব্য স্থান। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে প্রায় ৪৫ হাজার নারী কর্মী গেছেন দেশগুলোতে। সংখ্যাটি গত বছরের তুলনায় বেশি হলেও আগ্রহী কর্মী থাকলে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারত বলে জানান রিত্রুক্রটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি আবুল বাশার। তিনি বলেন, নির্যাতনের ভয়ে নারী কর্মীরা যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
গৃহস্থালির কাজের জন্য নারী শ্রমিক নিতে গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব। কথা ছিল, মাসে ১০ হাজার কর্মী যাবে। কর্মীদের কোনো খরচ হবে না। সব খরচ বহন করবে নিয়োগকারী। মাসিক বেতন প্রায় ১৬ হাজার টাকা। এ ঘোষণার পর নাম নিবন্ধন করতে রীতিমতো কর্মীদের ঢল নামে প্রবাসী কল্যাণ ভবন ও জেলা জনশক্তি কার্যালয়ে।
কিন্তু গত ১৫ মাসে মাত্র ৩৭ হাজার নারী কর্মী গেছেন সৌদি আরব। আরব আমিরাতে গত বছর ২৪ হাজার নারী কর্মী গেলেও চলতি বছরের তিন মাসে গেছেন মাত্র দুই হাজার ৫৭৬ জন। ওমান, কাতার ও জর্ডানের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। গত বছর ওমানে যান ১৬ হাজার ৯৮০ জন। এ বছর গেছেন ৫ হাজার ৪২৭ জন। গত বছর জর্ডান যান ২১ হাজার ৭৭৬ জন। চলতি বছর গেছেন ৮ হাজার ৬৬৭ জন।
নারীরা কেন আগ্রহ হারিয়েছে_ এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেছে বিদেশ ফেরত নারীদের কাছ থেকেই। গত এক বছরে প্রায় দেড়শ’ নারী কর্মী মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতিত হয়ে দেশে ফিরেছেন। গত এক বছরে ২০৪ নারী কর্মীর স্বজনরা তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে চিঠি দিয়েছেন। সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ জানান, গত বছর ৬০ জন নারী কর্মী কর্মস্থলে নির্যাতিত হয়ে দূতাবাসে আশ্রয় চান। তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
পাঁচজন বিদেশ ফেরত নারীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, শুধু সৌদি আরবে নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই গৃহকর্মী নির্যাতন হয়। সিরাজগঞ্জের এক নারী জানান, সৌদি আরবের নাজরান শহরের এক বাড়িতে তিনি কাজ করতেন। সাত মাস কাজ করে গত ১৭ মার্চ দেশে ফিরেছেন। ৩২ বছরের এ নারী ওড়না সরিয়ে দেখালেন, ওয়াশিং মেশিন চালাতে না পারায় গৃহকর্ত্রী তার চুল টেনে তুলে ফেলেছেন। গৃহকর্তাও তাকে পিটিয়েছেন।
ইস্টার্ন প্রভিন্সের জুবাইল শহরে কাজ করতেন গাজীপুরের এক নারী। তিনি জানালেন, গৃহকর্তা ও তার বন্ধুরা তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করেছে। এ কাজে গৃহকর্ত্রী তাদের বাধা দেননি বরং তাকে বাড়িতে আটকে রাখা হয়।
প্রবাসী নারী কর্মীদের সুরক্ষায় কাজ করে বমসা নামের একটি সংগঠন। এর পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যৌন হয়রানির চেয়েও বেশি ঘটে কাজের জন্য নির্যাতন। তিনি জানান, আরব দেশগুলোতে একান্নবর্তী পরিবার থাকে। একেকজন পুরুষের তিন থেকে চারজন স্ত্রী। ১০-১২টি সন্তান। তাদের সব কাজ করতে হয় বিদেশ থেকে আনা কাজের মেয়েদের। একজন গৃহকর্মীকে রাতে-দিনে ২১ ঘণ্টা কাজ করতে হয়।
গত বছর সৌদি আরব গেছেন ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী কর্মী। সেবার রোজার আগে ২০ হাজার নারী কর্মীর চাহিদা জানিয়েছিল সৌদি আরব। কর্মী সংগ্রহ, বাছাই ও পাঠানোর দায়িত্ব পায় ১১৫টি রিত্রুক্রটিং এজেন্সি। প্রত্যেক এজেন্সির সর্বোচ্চ ২০০ নারী কর্মী পাঠানোর সুযোগ ছিল; কিন্তু কোনো এজেন্সিই কোটা পূরণ করতে পারেনি।
এ ধারা অব্যাহত আছে চলতি বছরও। গত জানুয়ারিতে সৌদি আরব সফরে যান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি। তিনি সফর শেষে জানিয়েছিলেন, বছরে দুই লাখ নারী কর্মী নিতে আগ্রহী সৌদি আরব। নারী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের সঙ্গে একজন করে পুরুষ আত্মীয়ও বিনা খরচে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু এখনও এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি।