‘বাংলাদেশে উগ্রপন্থা বাড়ছে’

index 3_127608সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খবরের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৬ কোটি জনগণের বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম খবর হওয়া দেশগুলোর মধ্যে পড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি খবরের শিরোনাম হচ্ছে কিছু অপ্রীতিকর কারণে। প্রথমে এলো ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যা। ২০১৩ সাল থেকে এসব হত্যাকা-ের শিকারদের মধ্যে দুই ডজনেরও বেশি ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার, উদারপন্থি ও অন্যরা রয়েছেন। এদের হত্যা করা হয়েছে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে। এরপর ১১ই মে মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদ- কার্যকরের খবর এলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধে নৃশংসতা সংঘটনের দায়ে দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের এই নেতার মৃত্যুদ- দেয়া হয়।

খবরে যা কম এসেছে তা হলো, কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের পথে বাংলাদেশের অনুকম্পাহীন অধোগতি। এই তিন ঘটনার সবই একই রোগের লক্ষণ: একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না এবং যা ক্ষমতাকে দেখে ভিন্নমত নিষ্পেষণের উপায় হিসেবে।

বাংলাদেশ যে এই রোগ নিয়েই জন্ম নিয়েছে, নিজামীর ফাঁসি কার্যকর সেটাই মনে করিয়ে দেয়। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ওই যুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের লাখ লাখ মানুষ সম্ভবত মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নতুন দেশের সম্ভাবনা বিনষ্ট করতে বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী হত্যার অভিযোগ করা হয়। এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল পাকিস্তানপন্থি মিলিশিয়া বাহিনী আল-বদর। নিজামী ওই বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে ২০১৪ সালে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অনেক বাংলাদেশিই ক্ষুব্ধ যে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও ১৯৭১ সালে সংঘটিত অপরাধের জন্য কাউকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়নি। কাজেই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যখন ২০১০ সালে এর বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেন, তা ছিল জনপ্রিয় পদক্ষেপ। এটা এখনও জনপ্রিয় তবে এর প্রক্রিয়া হয়ে পড়লো হাস্যকর: ন্যায়বিচার সন্ধানের পরিবর্তে বিরোধী দলকে দমনের হাতিয়ার হয়ে গেল ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে নিজামীর ফাঁসি কার্যকর চতুর্থ ঘটনা। শেখ হাসিনার চিরপ্রতিন্দ্বী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার আগের জোট সরকারে একটি দল ছিল জামায়াতে ইসলামী। নিজামী খালেদা জিয়ার সরকারের শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। জামায়াত ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়লেও দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও তাদের শক্ত অবস্থান রয়েছে। নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর প্রতিবাদকারীরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। ৫ই মে নিজামীর আবেদন খারিজ হওয়ার পর জামায়াতের ডাকা হরতাল ঢিলেঢালাভাবে পালিত হয়।

বাংলাদেশে বলতে গেলে এক ধরনের ঘূর্ণায়মান একদলীয় ব্যবস্থা ছিল। শেখ হাসিনা চেষ্টা করছেন একদলীয় ব্যবস্থাকেই ধরে রাখতে। তবে সেটা রদবদল ছাড়াই। তার একজন সমর্থক মালয়েশিয়াকে আদর্শ মনে করেন। মালয়েশিয়াও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ, যেটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এবং যে দেশে রয়েছে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। তবে দেশটির একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতা থেকে সরানো আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার মাধ্যমে পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় থাকাকালীন ব্যর্থতা এবং আত্মসমৃদ্ধকরণ ও বিরোধীদের দমনে ক্ষমতা ব্যবহার করায় সৃষ্ট জনঅসন্তোষ এতে ভূমিকা রেখেছে। বিজয়ীরাই সব কিছু পাবে এমন মানসিকতা এতটা গভীরে প্রোথিত যে অবাধ নির্বাচনের সম্ভাবনা অচিন্তনীয়। আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো কথিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কিন্তু ২০০৮ সালে ভূমিধস বিজয়ের পর, আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রীতিমুক্ত হতে সংবিধান সংশোধন করে। ফলে, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে হওয়া সর্বশেষ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। জনপ্রিয় ম্যান্ডেটবিহীন এবং বিরোধীদের কোণঠাসা অবস্থায় লীগ গণমাধ্যমের ওপর বলপ্রয়োগ ও কণ্ঠরোধ করেছে। বড় অঙ্কের বেতন বৃদ্ধি করে সরকারি কর্মকর্তাদের নিজেদের দিকে টেনে নিয়েছে। আদালত, বেসামরিক প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ- প্রত্যেককে আদ্যোপান্ত রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং আইনে শাসনকে পদদলন করে বাংলাদেশ সরকার যে পার পেয়ে যেতে পারে তার পেছনে অনেকটাই ভূমিকা রাখে দুটি কারণ। একটা- দ্য ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’। এটা হলো- সবকিছু সত্ত্বেও দেশটির উন্নয়নের ধারা সম্মান করার মতো। যেমন করেই হোক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা অর্থনীতির ওপর তেমন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। দমন-পীড়ন, প্রতিবাদ-অবরোধ আর নিয়মিত সহিংসতা সত্ত্বেও প্রতিবছর জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে ৬ শতাংশের বেশি হারে।

২য় কারণ হলো, সাম্প্রতিক বিএনপি সরকারের জঘন্য দৃষ্টান্ত। তাদের অযোগ্যতা, দুর্নীতি আর কর্তৃত্বপরায়ণতা তো ছিলই। তার ওপর উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দিতে দেখা গেছে তাদের। তাদের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে। (যুদ্ধাপরাধ ছাড়াও নিজামী মন্ত্রী হিসেবে ২০০৪ সালের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পাচার কেলেঙ্কারিরে সম্পৃক্ততার জন্য দ-িত হয়েছেন)। বিরোধীদল হিসেবেও বিএনপির রেকর্ড আহামরি ভালো নয়। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে, সরকার পতনের প্রচেষ্টা হিসেবে পরিবহন অবরোধ পালন করতে গিয়ে বেসামরিক মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের পর উদারমনা, ধর্মনিরপেক্ষতার যে স্বপ্ন অনেক বাংলাদেশি দেখেছিলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের যাবতীয় অপকর্ম সত্ত্বেও ওই স্বপ্নের উত্তরাধিকারী। তবে, সাম্প্রতিক হত্যাকা-গুলো এসব আদর্শকে তামাশা বানিয়ে ছেড়েছে। যারা টার্গেট হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছে নাস্তিক, উদারমনা, হিন্দু, সমকামী অধিকার কর্মী এবং ৭ই মে একজন সুফি মুসলিম নেতা। সরকারের অব্যাহত দাবি, দোষীদের খুঁজে বের করার তৎপরতা চলছে, তাদের ধরা হচ্ছে এবং বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে এসব হামলার ভুক্তভোগীদের কথিত ইসলামবিরোধী অপরাধ নিয়ে সরকার যতটা সমালোচনামূলক, হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ততটা নয়। দ-মুক্তির একটি সংস্কৃতির ধারণা তৈরি হয়েছে। আর আওয়ামী লীগও ইসলামপন্থিদের তুষ্ট করছে বলে মনে করা হচ্ছে।

সরকার হত্যাকা-গুলোর জন্য দোষারোপ করছে বিএনপি ও জামায়াতকে। একইসঙ্গে তারা আইএস ও আল-কায়েদা দায়ী হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করছে। কেননা তারা বাংলাদেশে ইসলামপন্থি উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে নিজেদেরকে সর্বোত্তম সুরক্ষা হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। তবে বহির্বিশ্বের অনেকের শঙ্কা উগ্রপন্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত মাসে সিঙ্গাপুরে আটক হয় আট বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী। অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা ইসলামিক স্টেট ইন বাংলাদেশ নামে একটি গ্রুপ গঠন করেছে আর নিজেদের মাতৃভূমিতে হামলার ছক এঁকেছে। মূলধারার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উগ্রপন্থি দলগুলোর বলিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। ধর্মীয় হত্যাকা-গুলো হয়তো এটারই বীভৎস প্রমাণ দিচ্ছে। এগুলো বহির্বিশ্বে শিরোনাম হচ্ছে যা একটি দুঃস্বপ্নের ধারণা সৃষ্টি করছে। শেখ হাসিনাকেও ওই দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় বলে বলা হয়ে থাকে। সেটা হলো- দেশে নিজের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করার পর, কোনোভাবে হয়তো তার পতন ঘটাবেন অনধিকারচর্চাকারী বিদেশিরা।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.