পছন্দের ব্যক্তিদের ডিউটি দিয়ে চোরাচালানসহ নানা অপকর্মের জন্যই সিডিউলিং সফটওয়্যার অটোমেশন পদ্ধতি ব্যবহার করছে না বিমান। বিমানের চিহ্নিত একটি সিন্ডিকেট সফটওয়্যার প্রিন্ট ঘঁষামাজা করে এই ভয়াবহ ফ্লাইট বাণিজ্য শুরু করেছে। সফটওয়্যারের তালিকাভুক্ত ক্যাপ্টেন ও কেবিন ক্রুসহ অপারেটিং কর্মকর্তাদের অটোমেশন পদ্ধতির নাম কাটাছেঁড়া করে সিন্ডিকেটটি নিজস্ব ক্রুদের ডিউটি দিয়ে নানা অপকর্ম করছে। নিজদের ক্রু দিয়ে চালানো ওইসব ফ্লাইটে আনা হচ্ছে সোনা, ওষুধ এবং বিদেশী মুদ্রার চালান। সম্প্রতি বিমানের বিজি-০৮৯ (ময়ূরপঙ্খী) ফ্লাইটের টয়লেট থেকে বৃহস্পতিবার ১৫ কেজি সোনা উদ্ধারের পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের কাছে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে এ অপকর্মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৪ সালে গোয়েন্দা পুলিশ একই ধরনের অপরাধে ফ্লাইট অপারেশন অ্যান্ড সিডিউলিং বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন শহীদ ও সোনা চোরাচালান চক্রের গডফাদার পলাশসহ আটজনকে গ্রেফতার করে। তারা বর্তমান জেলহাজতে আছেন। বিমান সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ওই ঘটনার পর ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিমানের অপারেশন বিভাগ পুরোটাই সফটওয়্যার অটোমেশন পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসা হয়। বিমানের কোনো ফ্লাইটে কখন কার ডিউটি হবে সবই নির্ধারণ করা হতো এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে। কিন্তু ক্যাপ্টেন নাদিম মোস্তফা চিফ অব ফ্লাইট অপারেশন অ্যান্ড সিডিউলিং হিসেবে যোগ দেয়ার পর আবারও সেই আগের অ্যানালগ পদ্ধতিতে ফিরে যায় অপারেশন বিভাগ। অভিযোগ আছে, নাদিম মোস্তফা বাপার একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তিনি কাউকে পরোয়া করেন না। বাপার ওই শীর্ষ কর্তা চিফ অব প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিং বিভাগে বসে সফটওয়্যারের অটোমেশন প্রিন্টের তালিকা কাটছাঁট করে ম্যানুয়ালি তালিকা তৈরি করছেন।
অভিযোগ আছে, পাইলটদের সংগঠন বাপার শীর্ষ নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে আবারও সফটওয়্যার অটোমেশন পদ্ধতির সবকিছু ম্যানুয়ালি করা শুরু হয়েছে। সিন্ডিকেটটি প্রতিদিনই সফটওয়্যার থেকে ডিউটি রোস্টার প্রিন্ট আউট করছে ঠিকই, কিন্তু পরে সেটা নিজেদের মতো করে কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী বলেন, এভাবে যদি কেউ ঢালাওভাবে কিছু করে থাকে সেটা অবশ্যই অপরাধ। এটা চলতে পারে না। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে সবকিছু সিডিউলিং সফটওয়্যার অটোমেশন পদ্ধতিতেই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি আশা করছেন, শিগগিরই এটা ঠিক হয়ে যাবে। আমি শুনেছি, সিডিউল পরিবর্তন করে নানা অপকর্ম হচ্ছে। আমি সবকিছু আগামী ৩ মাস গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
২০১৪ সালের চাঞ্চল্যকর ওই চোরাচালান তদন্ত করতে গিয়ে তারা পাইলট, ক্রু, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৭৭ জনের তালিকা তৈরি করেছিলেন। যারা বর্তমানেও কর্মরত আছেন। সেখানে ১০ পাইলট ও ৫১ কেবিন ক্রুর নাম রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য (উত্তর) বিভাগ এ তালিকা তৈরি করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ৭৭ জনের তালিকার মধ্যে অধিকাংশই এখন ফ্লাইট অপারেশনের বিভিন্ন দায়িত্ব আছেন। অনেকে বাপার কার্যনির্বাহী কমিটির সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট। তিনি বলেন, তালিকাভুক্ত ফ্লাইট স্টুয়ার্ড মাজহারুল আফসার রাসেল, প্রভাবশালী ম্যানেজার মীরন, সহকারী ম্যানেজার হাই সিদ্দিকী, ক্যাপ্টেন আলী, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (ইফালপা) নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক, সাবেক সিডিউলিং চিফ ক্যাপ্টেন রেজওয়ান, ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন হাসান ইমাম, জুনিয়র সিডিউলার আবদুল মতিন, সিডিউলার সরোয়ার, নাসির ও রিটন এখনও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। এছাড়া কেবিন ক্রুদের মধ্যে ফ্লাইট স্টুয়ার্ড ও জুনিয়র পার্সার আখলাখ, আজম, সাপি, রিনি, নিশি, নিপা, হাসনা, শওকত, শারমিন, জাহিদ, ওয়াসিফ, জেনি, মুক্তা, হোসনে আরা, বিলকিস, বিথী, রাফসান, মুফতি, হাসিব, আশিক, মুগনি, রাজ, আরাফাত, আমিন, ইকরাম, আরিয়ান, শওগাত, আলম, আদনান, শফিক, আদিবা, আশফিয়া, তাসফিয়া, দিয়া, কসমিক, শ্যামা, জুয়েল, শ্রাবণী, বুলবুলি, মোতাহার, মুফতি, মৌ, মেহজাবিন, শুভ্রা, মেনুকা, মাসুম, নোমানীদের কারওর বিরুদ্ধেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিমান।
এছাড়া বিমানবন্দরকেন্দ্রিক একটি গোয়েন্দা সংস্থা সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বিমানের ৮ শীর্ষ কর্মকর্তার একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। তালিকাটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর বিমান মন্ত্রণালয় থেকে তালিকাটি যাচাই-বাছাই করার জন্য বিমানে পাঠানো হয়। এ তালিকায় বিমানের প্রভাবশালী পাইলট ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক, ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আবু আসলাম শহীদসহ আটজনের নাম রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও বিমান আজ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মূলত এ কারণেই এখন আবারও বেড়ে গেছে সোনা চোরাচালানসহ নানা অপরাধ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চিফ অব সিডিউলার ক্যাপ্টেন নাদিম মোস্তফার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে বাপার সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুব এ প্রসঙ্গে বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা সঠিক নয়। এখনও সফটওয়্যারের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। গোয়েন্দা তালিকায় থাকা সোনা চোরাচালানের সঙ্গে পাইলটদের নাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এগুলো বিমানের অভ্যন্তরীণ ও মন্ত্রণালয় থেকে একাধিক তদন্ত করা হয়েছে। কিন্তু তদন্তে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। কোনো তথ্যই সঠিক নয়।
এ বিষয়ে বিমানের সাবেক একজন ডিএফও জানান, বিশ্বের সব এয়ারলাইন্সে এমনকি পাশের দেশ নেপালেও পাইলটদের ডিডটি সিডিউল করা হয় সফটওয়্যারের অটোমেশন পদ্ধতিতে। এর আগেও চার কোটি টাকায় একটি ক্রু সিডিউলিং সফটওয়্যার কেনা হয়েছিল। কিন্তু তখনও বাপা তা চালু করতে দেয়নি। কারণ নিজেদের পছন্দসই ফ্লাইটে যাওয়া-আসা, নিজেদের পছন্দে এয়ারহোস্টেস নিয়ে যাওয়া, আকর্ষণীয় ও লাভজনক রুটে ডিউটি নিয়ে চোরচালানের সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্যই বাপা সেই সফটওয়্যার চালু করতে দেয়নি। এ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে সিডিউল বিভাগে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে ঘুষের বিনিময়েও পাইলটরা নিজেদের পছন্দের রুট পাচ্ছেন।
সূত্রঃযুগান্তর