গত দশ বছরের ব্যবধানে দেশের জনশক্তি রপ্তানি প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। ২০০৭ সালে যেখানে বাংলাদেশ থেকে ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন কর্মী বিদেশে যায় সেখানে গত বছর গিয়েছে ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ জন। সুতরাং ২০০৭ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে প্রায় অর্ধেক। চলতি ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত মোট জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৩১ জন।
শুধু যে জনশক্তি রপ্তানি কমেছে তাই নয়, এই সময়ের মধ্যে লিবিয়াসহ বেশ কয়েকটি প্রধান বাজার হাতছাড়া হয়ে গেছে। যা জনশক্তি রপ্তানি খাতের জন্য অশনি সংকেত। বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের জনশক্তির প্রধান বাজারগুলো স্থবির হওয়ায় কমছে রপ্তানি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি আবুল বাশার বলেন, নিরাপত্তার অজুহাতে আমাদের সরকার সে দেশে কর্মী পাঠাচ্ছে না। কিন্তু নেপাল, ভারত, পাকিস্তানসহ প্রতিযোগী দেশ থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার কর্মী যাচ্ছে দেশটিতে। তাছাড়া সেখানে বর্তমানে ৪০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আসলে এভাবে লিবিয়ার শ্রম বাজারটি বাংলাদেশের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা এ অবস্থার পরিত্রাণ চাই।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে ১৯৭৬ সালে মাত্র ৬ হাজর ৮৭ জন কর্মী বিদেশে যাওয়ার মাধ্যমে বিশ্ব শ্রম বাজারে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। সে বছর রেমিট্যান্স এসেছিল ২৩ দশমকি ৭১ মিলিয়ন ডলার বা ৩৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এই চলি্লশ বছরে জনশক্তি রপ্তানি ৫ লাখ থেকে ৮ লাখে ঠেকেছে এবং রেমিট্যান্স ঠেকেছে ১৫ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু যে হারে জনশক্তি রপ্তানি কমছে তাতে রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ ভালো থাকবে না।
জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষকরা মনে করছেন গত ৪০ বছরে মাত্র ৬ হাজার থেকে ৫ লাখ বা ৮ লাখে ঠেকেছে- এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের তুলনায় রপ্তানি কমে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এ বিষয়ে শ্রমবাজার বিশ্লেষক ড. তাসনিম সিদ্দিকী যায়যায়দিনকে বলেন, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, লিবিয়া, মালয়েশিয়ার মতো প্রধান বাজারগুলোতে একটা সময় প্রতি বছর ২ থেকে ৩ লাখ কর্মী গেছে। কিন্তু এসব দেশে এখন সারা বছরে ১০ থেকে ১৫ হাজারের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক যাচ্ছে। তাছাড়া লিবিয়াসহ কয়েকটি দেশের বাজার একেবারে বন্ধ রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের শ্রমশক্তির প্রধান বাজারগুলো এক রকম স্থবির রয়েছে। আর এ কারণেই কমছে জনশক্তি রপ্তানি।
এ বিষয়ে বায়রার প্রেসিডেন্ট আবুল বাশার বলেন, বর্তমানে জনশক্তি রপ্তানির বাজার স্থবির অবস্থায় আছে। অন্যতম প্রধান দেশ মালয়েশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করার পরও সে দেশে লোক পাঠানো যাচ্ছে না। সে দেশের সরকার চুক্তি নিয়ে লুকোচুরি করছে। একবার বলছে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে, অন্য সময় বলছে এ চুক্তি বাতিল হয়নি। অথচ আমাদের সরকার এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। আমরা একরকম অন্ধকারে আছি।
বিএমইটির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। ২০০৭ সালে জনশক্তি রপ্তানি হয় ৮ লাখ ৩২ হাজার ৬০৯ জন, আর ২০০৮ সালে রপ্তানি হয় ৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন। কিন্তু এর পর থেকেই কমতে থাকে জনশক্তি রপ্তানি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাশী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, ‘কৌশলগত এবং নিরাপত্তজনিত কারণে আমরা লিবিয়ায় আপাতত জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রেখেছি। দেশটির অবস্থা স্বাভাবিক হলে আবারো সে দেশে জনশক্তি রপ্তানি করবো।’ আর সামগ্রিক জনশক্তি রপ্তানি কমার বিষয়ে তিনি বলেন, জনশক্তি রপ্তানির ধারা স্বাভাবিকই রয়েছে।
এদিকে জনশক্তির সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যে এখন খুব বেশি মানুষ যাচ্ছে না। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ বায়রার সাধারণ সম্পাদক মনসুর আহমেদ কালাম মনে করেন, কূটনৈতিক ব্যর্থতাই এর মূল কারণ।
তিনি বলেন, ‘কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। আগের তুলনায় আমরা ৫ শতাংশ মানুষও পাঠাতে পারি না। মালয়েশিয়ার বাজারও বন্ধ। ফলে আমরা একটা খারাপ সময় পার করছি।’
রাশিয়ার বাজারে নতুন করে শ্রমিক পাঠানো যাবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে মনসুর আহমেদ জানান, বর্তমানে এক কোটির মতো শ্রমিক বিভিন্ন দেশে আছেন। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশের মানুষ কাজ করছেন। এ সময় শিগগিরই মালয়েশিয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে- এমন আশ্বাস পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অবস্থা খুব একটা ভালো না। যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি পাঠানো হয় তার মধ্যে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও কাতার অন্যতম। এর মধ্যে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির হার খুবই নগণ্য। অন্য সময়ের তুলনায় এখন ৫ শতাংশ লোক সৌদি আরবে যাচ্ছে। আগে এক সময় মহিলারা সৌদি আরবে যেত। ৭-৮ বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের শেষ দিক থেকে মহিলাদের আবার পাঠানো শুরু হয়েছে। তারা ওখানে গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ করেন। আর মালয়েশিয়াতেও জনশক্তি রপ্তানি একেবারে বন্ধ। প্রফেশনাল ক্যাটাগরিতে কিছু লোক সেখানে যেত, তাও দুই মাস ধরে বন্ধ। গত সাড়ে তিন বছর ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাত কোনো লোক নিচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দু-একজন ‘ক্লিনার’ যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তাই জনশক্তি রপ্তানি একেবারে নগণ্য পর্যায়ে রয়েছে।
বায়রা সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের একটা বড় বাজার হলো সৌদি আরব। তারা অনেকদিন ধরে কোনো লোক নিচ্ছে না। এর জন্য আমাদেরও দায় আছে। সেখানে অবস্থান করা আমাদের লোকজন প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ ও হানাহানিতে লিপ্ত হয়। মানুষ খুন পর্যন্ত করেছে বাঙালিরা। সে কারণে একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্কটাকেও দায়ী। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব আশ্বাস দিচ্ছে তারা লোক নেবে। কিন্তু নিচ্ছে না। এখানে কূটনৈতিক ব্যর্থতা বড় কারণ। দুবাইতে কিন্তু এক সময় এক-দেড় লাখ লোকও গেছে। সেখানেও অনেকদিন ধরে লোক পাঠানো বন্ধ। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শুধু ম্যানপাওয়ার এক্সপোর্টকে সচল করার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। তিনিও পারেননি বা হয়নি। এভাবে বিভিন্ন দেশে লোকজন খুবই অল্প পরিমাণে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার ব্যাপারে চুক্তি হলো। পরের দিনই ওরা বাইরে থেকে সব শ্রমিক নেয়া বন্ধ করে দিল। এখন শোনা যাচ্ছে তারা বাজারটা উন্মুক্ত করে দেবে। তাহলে অবশ্য এখান থেকে বেশ কিছু শ্রমিক যাওয়ার সুযোগ পাবে।