বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদা, আইএসের অস্তিত্ব রয়েছে আমেরিকার এমন দাবির সঙ্গে একমত নয় প্রতিবেশী দেশ ভারত।
তাদের মতে, সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলো এদেশেরই জঙ্গি সংগঠনের কাজ। আর এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে ভারত।
দেশটির পক্ষ থেকে সরাসরি এমনই বার্তা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়কে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ সমর্থন জানাতেই সম্প্রতি ঢাকা সফরে আসেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানান ভারতের বিদেশ সচিব ড. সুব্রাহ্মনিয়াম জয়শঙ্কর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকা সফরকালে বিভিন্ন বৈঠকের কোনোটিতেই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের বিষয়টি উল্লেখ করেননি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। যদিও নিরাপত্তার বিষয়ে প্রত্যক্ষ উদ্বেগের কথা বলে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে গেছেন ড. জয়শঙ্কর।
বিভিন্ন বৈঠক সূত্রে জানা যায়, দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের ‘সবচেয়ে ভালো এই সময়ে’ কীভাবে আরও সহযোগিতা বাড়ানো যায়, সেসব বিষয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব।
তিনি সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠক করে এসব বিষয়ে জানতে চান। বৈঠকগুলোতে দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলেন নাগরিক প্রতিনিধিরা।
সেখানেও উঠে আসে বিভিন্ন সংগঠনের দায় স্বীকারের বিষয়টি। তবে এ নিয়ে খুব বেশি দুঃশ্চিন্তা করতে দেখা যায়নি এই কুটনীতিককে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে- বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে বলে ভারত বিশ্বাস করে না।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কয়েকদিন আগে ঢাকা সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালও ভারতের এ মনোভাব নিশ্চিত হয়ে ফিরেছেন।
ওই সফরে তিনি ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে একটি বৈঠক করেন।
জানা যায়, বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়েদার মতো সংগঠনের অস্তিত্ব রয়েছে এমন কঠিন দাবি নিয়েই বৈঠকের শুরু করেন নিশা।
তবে তার কঠোর অবস্থানের বিপরীতে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টি অস্বীকার করে ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা এদেশের মানুষের প্রকৃতি ব্যাখ্যা নিয়ে বলেন, ‘এরা শান্তি প্রিয়, সহিষ্ণু জাতি।’
এ সময় তিনি পহেলা বৈশাখ উদযাপনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সকল ধর্ম বর্ণের মানুষ মিলে মিশে যেখানে এমন উৎসব আয়োজন করতে পারে, সে দেশে আইএস বা আল কায়েদা থাকতে পারে না।’
বৈঠকে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর দায় স্বীকারের বিষয়টিও উল্লেখ করেন নিশা। তবে এসব কাজ দেশীয় জঙ্গির বলে মত দেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।
আধাঘণ্টার ওই বৈঠকের শেষদিকে নিজের মত কিছুটা হলেও পাল্টাতে বাধ্য হন নিশা দেশাই।
বৈঠক সূত্র জানায়, ভারতের যুক্তিতে শেষ মেষ তিনি এটা বলতে বাধ্য হন, ‘‘এখানে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব না থাকলেও দেশীয় জঙ্গিদের সঙ্গে তাদের ‘কানেকশন’ রয়েছে।’’
বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়ে নিশা দেশাইয়ের উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের সবচেয়ে কাছে। এদেশে নিরাপত্তাহীনতায় পড়লে সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত। তাই ভারত সরকার এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে।
আর এ সহযোগিতা যে দ্বি-পক্ষীয়ভাবেই হবে তা স্পষ্ট্র করে গেছেন দেশটির পররাষ্ট্র সচিব ড. সুব্রাহ্মনিয়াম জয়শঙ্কর।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধু। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে দ্বি-পক্ষীয় সহযোগিতার প্রচলিত এজেন্ডাগুলো রয়েছে, সেখানে সন্ত্রাস দমন বেশ পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত।’
‘আগেও এ বিষয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি, যার মাধ্যমে ভালো ফলও এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশ সফরে এসে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সেই সহযোগিতাকে আরও জোরদার করার পুনর্ব্যক্ত করে গেছেন,’ বলেন তিনি।
এদিকে দু’দেশের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ককে ‘অত্যন্ত সুখকর’ বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, এখন দুই দেশের রাজনীতিকদের দায়িত্ব এই সম্পর্ক টেনে নেওয়া ও দু’দেশের জনগণকে এর সুফল ভোগ করতে দেওয়া।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গির সম্পৃক্ততা নিয়ে আমেরিকার বক্তব্যের সমালোচনাও করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রমাণ ছাড়া আন্তর্জাতিক জঙ্গির অস্তিত্ব থাকার বিষয়ে আমেরিকার মন্তব্য হাস্যকর। প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের কথা তারা বলতে পারে না।’
তবে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতাকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি।
একই বিভাগের অধ্যাপক মুহা. রুহুল আমিন বলেন, ‘সম্প্রতি একজন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সাত সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এটা এক সময় কল্পনাতীত ছিলো।
‘এর অর্থ দেশটির রাজনীতিকদের কাছ থেকে এ ধরনের নির্দেশনাই পেয়েছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। অন্যান্য ক্ষেত্রেও দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ছে। যে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে এমন সম্পর্ক থাকাটা সুখকর বিষয়।’
‘সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এমন সুন্দর ও সুখকর সম্পর্কই থাকা উচিত,’ মন্তব্য করেন এই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।