শাহজালাল বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ও পণ্য পরিবহনে বেহাল দশা

1হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং কার্গো পণ্য পরিবহনে বেহাল দশার সৃষ্টি হয়েছে। সময়মত পণ্য খালাস না হওয়াতে শত শত কোটি টাকার মালামাল বিমানবন্দরের কার্গো শাখা খোলা আকাশের নীচে পড়ে আছে। দক্ষ জনবলের অভাবে মালামাল স্ক্যানিং করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। বিস্ফোরক ও তরল ক্যামিকেল পদার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। আবার ভুয়া আইডি কার্ড নিয়ে অবাধে প্রবেশ করছে ব্যবসায়ী নামধারী একশ্রেণীর দালাল। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় এরা অবাধে বিমানবন্দরের ভিতরে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। ফলে বিমান মন্ত্রণালয়ের নানামুখী উদ্যোগ ও সংশ্লিষ্টদের হাঁকডাক কোন কিছুতেই কাজে আসছে না। বরং পণ্য খালাস, রপ্তানী এবং মালামাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আরো বেহাল দশার সৃষ্টি হয়েছে। আগের চেয়ে কাজের গতিও কমে আসছে। একশ্রেণীর কর্মকর্তা,কর্মচারীর দায়িত্বে অবহেলা এবং মনিটরিংয়ের অভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, বিমান এবং নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং তাদের যথাযথভাবে মনিটরিং না করায় এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত ১৫ দিনে আমদানী ও রপ্তানী শাখায় কয়েক হাজার কোটি টাকার মালামাল আটক পড়ে আছে। এতে করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা দেখা দিয়েছে।
গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার কার্গো ভিলেজে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সীমাহীন অনিয়ম অব্যবস্থাপনা। পণ্য খালাসে কাজের গতি নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও অনেকেই পণ্য খালাস করতে পারেননি। স্ক্যানিং মেশিন দিয়ে পণ্য পরীক্ষা চলছে ধীরগতিতে। আবার এর অপারেটরের সংখ্যাও কম। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্য যেসব শর্ত দিয়েছিল তাও পূরণ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শর্তগুলোর অন্যতম হচ্ছে কার্গো কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা জোরদার, নিজস্ব জনবল ও দক্ষ স্ক্যানিং মেশিন অপারেটর নিয়োগ ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, নতুন করে লোক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কার্গো ভিলেজে নানা অনিয়ম দূর করতে যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। নতুন কয়েকটি স্ক্যানিং মেশিন স্থাপনের কাজ চলছে। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। যুক্তরাজ্যর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। পণ্য যাতে দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় কার্গো কর্তৃপক্ষকে সেদিকে নজর দিতে বলা হয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নানা অনিয়মের মধ্যে চলছে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ শাখার কর্মকা-। ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থা রেডলাইনকে দায়িত্ব দেওয়ার পর অনিয়মের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে। তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পণ্য স্ক্যানিং করার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করা হচ্ছে। এমনকি পণ্য পাঠানোতেও হয়রানি পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া যারা কাজ করছেন তাদের অদক্ষতা, দুর্নীতি-লুটপাট দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির গ্রেড উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল ছাড়াই কার্গো শাখার কাজ পরিচালনা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এ নিয়ে দফায় দফায় শুধু বৈঠকই হয়েছে। কোন উন্নতি হয়নি। নেই কাজের গতি। বরং এখন আগের চেয়ে বেশী সময় ক্ষেপণ হচ্ছে পণ্য রপ্তানী ও খালাসে।
সূত্র মতে, সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া আরএ-৩ সনদ পুনর্বহাল করেছে বলে বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। তবে তাদের সব শর্ত দ্রুত পূরণ করতেও তাগাদা দেওয়া হয়েছে। নানা অনিয়মের কারণে এয়ার কার্গো সিকিউরিটি এসিসি-৩ ও আরএ-৩ সনদ বন্ধ করে দেয় অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্য।
গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতকরণের দু’টি সনদ রক্ষায় শাহজালালের স্ক্যানিং বিভাগে আরো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, অভিজ্ঞ এবং শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতেই হবে। বিমানবন্দরে নিরাপত্তা দিতে ব্রিটিশ নিরাপত্তা সংস্থা রেডলাইনকে দায়িত্ব দেওয়ার পর পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে জানা গেছে। তাদের দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
সিভিল এভিয়েশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিমানবন্দরের স্ক্যানিং তল্লাশির সক্ষমতা বাড়ানোসহ যাত্রী ও কার্গোর নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের স্ক্যানিং টেকনোলজির আলোকে আমরা সেদিকে যাচ্ছি। বিমানবন্দরে নিরাপত্তা আরো বাড়াতে তিন সেট ইডিএস, আট সেট ডুয়েল ভিউ এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন, ১৪ সেট ডুয়েল ভিউ এক্সরে স্ক্যানিং মেশিন ফর কেবিন উইথ ট্রে রিটার্ন সিস্টেম, ৯ সেট আন্ডার ভেহিকল স্ক্যানিং মেশিন ও ১৪ সেট এক্সপোসিভ ট্রেস ডিটেক্টর (ইডিটি), ছয় সেট লিকুইড এক্সপোসিভ ডিটেকশন সিস্টেম ও একটি ডাবল ক্যাব পিকআপ, ইটিভি কনসুমাবেলস ফর এক্সপ্লোসি ট্রান্স ডিটেক্টর মেশিন শিগগির দেশের বাইরে থেকে আনা হচ্ছে। কার্গো হাউসে অনিয়ম হচ্ছে তা সত্য। এর পরও আমাদের চেষ্টার কমতি নেই।
বিমানের কার্গো শাখার জেনারেল ম্যানেজার আলী আহসান বাবু বলেছেন, কার্গো শাখার পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেক ভালো। আরো ভালো করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে আরো দক্ষ জনবলের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, প্রয়োজনী জনবল নিয়োগ দেয়ার পাশাপাশি অত্যাধুনিক স্ক্যানিং মেশিন ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালায়েড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর বলেন, ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বাংলাদেশ থেকে সেখানে সরাসরি পণ্য রপ্তানি করা যায় না। তৃতীয় কোনো দেশে আমাদের পণ্যের স্ক্যানিং শেষে তা ইউরোপের বাজারে ঢুকতে পারে। ফলে এখানে অনেক সময়ক্ষেপণ হয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সরাসরি পণ্য রপ্তানি করা গেলেও বিমানবন্দরে স্ক্যানিংয়ের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক পণ্য বিমানবন্দর থেকে বিশেষ করে পচনশীল পণ্য ফেরত নিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। আবার সময়ক্ষেপণের কারণে বাড়তি অর্থও গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।. তিনি বলেন, স্ক্যানিংয়ের জন্য চার ঘণ্টা সময় নির্ধারিত হলেও বর্তমানে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লাগছে। এ ছাড়া অর্থও বেশি খরচ হচ্ছে। এগুলো সরকারকে দেখতে হবে। আর না হয় ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছরের ৮ মার্চ শাহজালালের কার্গো ফ্লাইটের ওপর যুক্তরাজ্যের ডিএফটির নিষেধাজ্ঞা জারির পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় সব পয়েন্টেই। যুক্তরাজ্যের রেডলাইন দায়িত্ব নিয়ে কাজও শুরু করে। রেডলাইন কাজ শুরুর পরও সন্দেহ দূর না হওয়ায় শাহজালালে যুক্তরাজ্যগামী যাত্রীবাহী ফ্লাইটের যাত্রী ও লাগেজ তল্লাশি করা হচ্ছে একাধিকবার। এতে করে ফ্লাইট সিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের কাজ দেওয়া হয় ব্রিটিশ ওই কোম্পানিকে। ২১ মার্চ রেডলাইনের সঙ্গে দুই বছরের জন্য সরকারের চুক্তি হয়। আর এ জন্য রেডলাইনকে দেওয়া হবে ৭৪ কোটি টাকা। যুক্তরাজ্য সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানো এবং বাংলাদেশ বিমানের লন্ডন ফ্লাইটকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর পরও কার্গো ভিলেজে হয়রানি, ভোগান্তি আর সময়ক্ষেপণ বন্ধ হয়নি।
সিএএবির এক কর্মকর্তা বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় যুক্তরাজ্য সরকার যে কয়েকটি দেশের বিমানবন্দরের তালিকা করেছে এর মধ্যে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরও রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট গত জানুয়ারি মাস থেকেই শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। তারা ছদ্মবেশে কার্গো ভবনে বিনা বাধায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তারা দেখতে পায়, মালামাল স্ক্যানিং করা হচ্ছে নামমাত্র। এতে যুক্তরাজ্য অসন্তোষ প্রকাশ করে শাহজালালের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট ২০০৭ ও ২০০৯ সালে দু’বার বাংলাদেশকে পণ্য পরিবহন স্থান, যাত্রী ও তাদের পণ্য তল্লাশি এবং বিমানবন্দরে কর্মরত দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কী ধরনের নীতিমালা ও পদক্ষেপ নিতে হবে তা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছিল। অথচ ওই দুটি প্রতিবেদনকে সরকার বিবেচনায় নেয়নি।

সূত্রঃ ইনকিলাব

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.