বাংলাদেশ বিমানে লোকসানের ভূত পিছু ছাড়ে না

Biman-bangladeshএভিয়েশন নিউজ: আধুনিকায়নের কর্মসূচি চলছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে। বাদ পড়েছে চারটি পুরনো ডিসি-১০ উড়োজাহাজ। বহরে এসেছে জ্বালানি সাশ্রয়ী অত্যাধুনিক বোয়িং। নতুন গন্তব্যে ডানা মেলেছে বিমান। বেড়েছে যাত্রী পরিবহনক্ষমতা। এত কিছুর পরও লোকসানের ভূত কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না জাতীয় পতাকাবাহী এ সংস্থার। নিম্নমুখী যাত্রী পরিষেবায় ক্রমেই অন্ধকারে ডুবছে এর ভবিষ্যৎ।

জানা গেছে, বিমানের ১৯টি আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে অন্তত ৯টি এখন লোকসানি। বাকি ১০টি রুটের মধ্যে তিনটিতে মাঝেমধ্যেই লোকসান হচ্ছে। লাভজনক রুট সাকল্যে সাতটি। এ অবস্থায় গত চার অর্থবছরে বিমানের লোকসান হয়েছে প্রায় এক হাজার ২৬৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত অর্থবছরে এয়ারলাইনসটি লোকসান গুনেছে প্রায় ২৫৪ কোটি টাকা। ২০১০-১১ অর্থবছরে ২২৪ কোটি ১৬ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫৯৪ কোটি ২১ লাখ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে বিমান।

১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করা বিমানের উড়োজাহাজ-বহরে রয়েছে নিজস্ব চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০, ইজারা নেওয়া দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ এবং ভাড়া নেওয়া দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও দুটি এয়ারবাস ৩১০-৩০০। আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় গত বছর বহর থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে পুরনো চারটি ডিসি-১০। কিন্তু যাত্রীর অভাবে এয়ারলাইনসটি কলকাতা, দিল্লি, ইয়াঙ্গুন, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, হংকং, রোম, ফ্রাংকফুর্ট ও লন্ডন রুটে লোকসান দিচ্ছে। এ ছাড়া দুবাই, আবুধাবি ও মাসকাট রুটে মাঝেমধ্যেই তারা লোকসান দিচ্ছে। আর পুরোপুরি লাভজনক রুট হচ্ছে কুয়ালালামপুর, কাঠমাণ্ডু, দোহা, কুয়েত, রিয়াদ, জেদ্দা ও দাম্মাম।

বিমান সূত্র জানায়, তুলনামূলকভাবে ১৯৯০ সালের পর বিমানের লোকসানের প্রবণতা বেড়েছে। ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে গত ১৯ বছরে মাত্র চার বছর লাভ হয়েছিল বিমানে। সর্বশেষ এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুই বছর লাভের মুখ দেখেছে তারা। ২০০৩-০৪ সালে তিন কোটি ৫০ লাখ, ২০০৭-০৮ সালে পাঁচ কোটি ৯১ লাখ এবং ২০০৮-০৯ সালে ১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় বিমানের নতুন পরিচালনা পর্ষদ। আর তখন আবারও শুরু হয় লোকসানের পালা।

লোকসানের ভূত পিছু ছাড়ে না
সূত্র মতে, লোকসানের কারণে ২০০৬ সালে বিমান কর্তৃপক্ষ ফ্রাংকফুর্ট, নারিতা, ম্যানচেস্টারসহ মোট আটটি রুট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সাবেক ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের কর্মকর্তা কেভিন স্টিল বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আকস্মিকভাবে আবারও চালু হয় ফ্রাংকফুর্ট ফ্লাইট। বাণিজ্যিক সুবিধার কথা ভেবে চালু হয় ইয়াঙ্গুন ফ্লাইট। কিন্তু জনপ্রিয় নয় বলে এই দুটি রুটে পুরোপুরি লোকসান দিচ্ছে বিমান। ন্যূনতম যাত্রীর অভাবে প্রায়ই যাত্রা বাতিলের নজির রয়েছে ফ্রাংকফুর্ট রুটে। আর ব্যবসায়িক বা পর্যটনের দিক থেকে আকর্ষণীয় নয় বলে ইয়াঙ্গুন ফ্লাইটেও রয়েছে ব্যাপক যাত্রীশূন্যতা। একইভাবে লোকসান গুনছে রোম ফ্লাইটও।

Biman-Bangladesh

আঞ্চলিক ফ্লাইটের মধ্যে ভারতের কলকাতা ও দিল্লি ফ্লাইটেও টানা লোকসান গুনছে বিমান। সূত্র মতে, আঞ্চলিক ফ্লাইটের জন্য ছোটমাপের উড়োজাহাজে সাশ্রয় করার সুযোগ রয়েছে। আর চিকিৎসা, ভ্রমণ ও ব্যবসায়িক কাজে ঢাকা-কলকাতা রুটে রয়েছে ব্যাপকসংখ্যক যাত্রী। কিন্তু বিমানের কলকাতা ফ্লাইট চলছে ২২১ আসনের সুপরিসর এয়ারবাস ৩১০-৩০০ উড়োজাহাজে। তাই তুলনামূলকভাবে কলকাতা ফ্লাইটের ভাড়া কম হলেও জ্বালানির সাশ্রয় না হওয়ায় এই রুটে হচ্ছে লোকসান।

অন্যদিকে অব্যাহত লোকসানের মুখে বছর আটেক আগে ঢাকা-দিল্লি-নিউ ইয়র্ক রুটের মধ্যে নিউ ইয়র্ক ফ্লাইটটি বন্ধ করে বিমান। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে চালু রেখেছে লোকসানি দিল্লি ফ্লাইট। আবার বিমানের ঢাকা-মুম্বাই-দুবাই রুট ছিল লাভজনক। কিন্তু এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মুম্বাই ফ্লাইট বন্ধ করে চালু হয় সরাসরি দুবাই ফ্লাইট। এখন এই রুটে মাঝেমধ্যেই লোকসান গুনতে হচ্ছে। সপ্তাহে প্রতিদিন পর্যাপ্তসংখ্যক ফ্লাইট না থাকায় লোকসান হচ্ছে দুবাই ও আবুধাবি ফ্লাইটে। এ ছাড়া ব্যাংকক ও সিঙ্গাপুর রুটে একসময় লাভ করলেও দুই রুটেই এখন দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকটি এয়ারলাইনস ফ্লাইটসংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। আর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে লোকসান দিচ্ছে বিমান। এয়ারলাইনসটির মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোর মধ্যে সব সময়ই জেদ্দা, রিয়াদ ও দাম্মাম ফ্লাইট লাভজনক। কারণ হিসেবে জানা গেছে, এই তিনটি রুটে ৪১৯ আসনের সুপরিসর বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ চালানোয় পর্যাপ্ত যাত্রী ও কার্গো পরিবহন করতে পারছে বিমান। আবার পর্যাপ্ত যাত্রী ও কার্গোর অভাবে ১২২ আসনের এয়ারবাস উড়োজাহাজ চালানোয় মাঝে মাঝে লোকসান হচ্ছে কুয়েত, মাসকাট ও দোহা রুটে।

ইউরোপের মধ্যে লন্ডন ফ্লাইটও ক্রমেই যাত্রী হারাচ্ছে। তুলনামূলকভাবে ভাড়া কম রেখেও এই রুটে লোকসান গুনছে বিমান। গত ডিসেম্বরে বিমানের লন্ডন ফ্লাইটের ভাড়া ছিল এক হাজার ২৩১ ডলার (ইকোনমি ক্লাস) ও দুই হাজার ২১৫ ডলার (বিজনেস ক্লাস)। একই সময় একই রুটে বাড়তি ভাড়া গুনেও লাভ করেছে এমিরেটস এয়ারলাইনস। তাদের ভাড়া যথাক্রমে দুই হাজার ৭৭৭ ডলার (ইকোনমি) ও এক হাজার ১৬৯ (বিজনেস) ডলার। কারণ তাদের রয়েছে আরামদায়ক ভ্রমণের পেশাদার পরিষেবা।

লোকসানের যত কারণ 
বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে বছর দুয়েক আগেও নিয়মিত ভ্রমণ করতেন ঢাকার টেক্সটাইল ব্যবসায়ী জসিম আহমেদ। কিন্তু নানা কারণে তিনি এখন আর বিমানে ভ্রমণ করতে রাজি নন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া কম বা বেশি হলেও বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদের কাছে সেটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বোয়িং যোগ হওয়ায় বিমানের লন্ডন ফ্লাইটের সময়ানুবর্তিতাও বেড়েছে। কিন্তু মূল সমস্য হলো ইন-ফ্লাইট সার্ভিস। যাত্রী পরিষেবার পেশাদারিত্বের কিছুই বিমানের নেই। খাবার ও পানীয়র মান খুবই খারাপ। টয়লেট থাকে নোংরা। ট্রানজিট বা বিলম্বিত যাত্রীদের বিমান কর্তৃপক্ষ মোটেও দেখভাল করে না। সে তুলনায় কিছুটা বেশি ভাড়া গুনেও অন্য এয়ারলাইনসে লন্ডন ফ্লাইটে আরামদায়ক ভ্রমণ সম্ভব।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলমও মনে করেন, পরিষেবায় পিছিয়ে পড়ার কারণেই সব সম্ভাবনাময় রুটে লোকসান গুনছে বিমান। পাশাপাশি রয়েছে রুটবিন্যাস পরিকল্পনার অভাব। বাজার জরিপ, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ছাড়াই ফ্রাংকফুর্ট, ইয়াংগুন, রোম, হংকং, দিল্লি ফ্লাইট চালানোয় বিপুল অর্থ লোকসান দিচ্ছে এয়ারলাইনসটি। যাত্রীশূন্যতায় ফ্রাংকফুর্ট রুটে ছয় মাসে তারা প্রায় ৪০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। এ ছাড়া যথাযথ বাণিজ্যিক কৌশল, পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবেও লোকসান দিচ্ছে বিমান। আর নানা খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিতেও লোকসান বেড়েছে।

ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিমানকে চাঙ্গা করতে হলে এর খোলনলচে পাল্টে ফেলতে হবে। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটি দিয়ে কাজ হবে না। প্রয়োজনে বিদেশি এয়ারলাইনসের সহায়তা নিয়েও বিমানকে লাভজনক করার চেষ্টা করা যায়। ওয়াহিদুল আলম উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভারতের লোকসানি এয়ারলাইনস জেট এয়ারের ৪০ শতাংশ শেয়ার কিনেছে আবুধাবির রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইনস ইত্তেহাদ। এখন বিদেশি বিনিয়োগে জেট এয়ার লাভের মুখ দেখছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে বিমানেও এমন বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভব। আর এ জন্য চাই সদিচ্ছা।

Biman-Bangladesh-Bhaban

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনবিষয়ক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বের কোনো দেশেই রাষ্ট্রীয় কোনো এয়ারলাইনস বিমানের মতো চড়া দামে জেট ফুয়েল কেনে না। এমনকি প্রতিবেশী এয়ার ইন্ডিয়াও বিমানের তুলনায় অনেক কম দামে জেট ফুয়েল কিনতে পারে। আর বিমানকে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে চড়া দামে জেট ফুয়েল কিনতে হয়। উপরন্তু জেট ফুয়েলের ওপর রয়েছে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট)। এসব কারণে বিমানের ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৪৯ শতাংশ অর্থই এখন ব্যয় হচ্ছে জেট ফুয়েলের জন্য। ফলে কিছুতেই লাভে যেতে পারছে না বিমান।

লোকসানের অন্যান্য কারণ হিসেবে মেনন বলেন, বিমানের রুটবিন্যাসে অদক্ষতার কথা। মন্ত্রী বলেন, যথাযথ রুটবিন্যাস না করায় ফ্রাংকফুর্টসহ বেশ কয়েকটি রুটে টানা লোকসান হচ্ছে। শিগগিরই বিমানের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি কায়েল হিয়ুডের নেতৃত্বে এয়ারলাইনসটির সব রুট পুনর্বিন্যাস করা হবে। বেশ কয়েকটি রুট বাতিল করে প্রয়োজনে খোলা হবে নতুন রুট। মন্ত্রী বলেন, নানা খাতের অপচয় ও দুর্নীতির কারণেও লোকসান হচ্ছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি এসব অপচয়-দুর্নীতি রোধ করার।

এদিকে বিপিসির পরিচালক (পরিচালনা) মোসলেহ উদ্দীন জানান, বিমান বাদে অন্য সব দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনস পদ্মা অয়েল কম্পানির মাধ্যমে নগদে জেট ফুয়েল কেনে বলে তারা আন্তর্জাতিক দরেই তেল সরবরাহ পায়। কিন্তু বাকিতে জেট ফুয়েল সরবরাহে পদ্মা অয়েল কম্পানির সঙ্গে বিমানের চুক্তি রয়েছে। তাই তাদের আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়েও বেশি দামে জেট ফুয়েল কিনতে হয়। আর এই ক্রয়মূল্যের ওপর ভ্যাটসহ অন্যান্য কর আরোপও হয় বেশি মাত্রায়। সব মিলিয়ে বিমানের খরচ বাড়ে।

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিমানের লোকসান আগের চেয়ে কমে এসেছে। কমিটির পক্ষ থেকে লোকসানি রুটগুলো বন্ধ করে লাভজনক রুটগুলোতে আরো ভালো সেবা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সুপারিশ করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ রুটগুলো সচল করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের। সাবেক এই বিমানমন্ত্রী বলেন, বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানের টিকিট পাওয়া যায় না বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেন। আবার অনেক আসন খালি নিয়ে বিমান আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করছে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পুরোপুরি ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর কাজ চলছে।

– বিপ্লব রহমান

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.