এভিয়েশন নিউজ: বাংলাদেশ বিমানের জেদ্দা অফিসের কান্ট্রি ম্যানেজার ও জিএসএ (জেনারেল সেল্স এজেন্ট) এলাফ এভিয়েশনের বিরুদ্ধে ১৩৩ কোটি টাকা লোপাট ও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্টেশন ম্যানেজারের নাম আবু তাহের।
বিমানের প্রধান কার্যালয়ের একজন পরিচালক ও একজন জেনারেল ম্যানেজারের যোগসাজসে পুরো টাকা লোপাটের ঘটনা ঘটেছে। সংস্থার অভ্যন্তরিন তদন্তে প্রাথমিকভাবে এই অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে বলে বিমান সুত্রে জানাগেছে। বিমানের পরিচালক প্রশাসন রাজপতি সরকার বলেন, জেদ্দা অফিস নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ আছে।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের অভিযোগ পাওয়ার পরপরই ম্যানেজমেন্ট তদন্ত করবে। এর আগে বিমানের একজন জেনারেল ম্যানেজার আমিনুলের (সাবেক ভুমি মন্ত্রীর জামাতা) বিরুদ্ধে এধরনের মোটা অংকের টাকা দুর্নীতির অভিযোগে চার্জশীট গঠন করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রায় ৭৮০ কোটি টাকার দুনীতির তদন্ত চলছে। পরিচালক প্রশাসন রাজপতি সরকার জানান, আমিনুলের বিরুদ্ধে তদন্ত চুড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাগেছে বিমানের সেক্টর ভিত্তিক হাজার হাজার কোটি টাকা দুনীতির অভিযোগ থাকলেও ব্যক্তি কেন্দ্রীক এধরনের বড় দুর্নীতির সংখ্যা হাতে গোনা। দুটি ঘটনায় বিমান জুড়ে তোলপাড় উঠেছে। ইতোমধ্যে বিমানের জেদ্দাস্থ কান্টি ম্যানেজার আবু তাহেরকে জেদ্দা স্টেশন থেকে সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিমান।
পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতি ও আবু তাহেরকে সহায়তার অভিযোগে জিএসএ এলাফ এভিয়েশনের সঙ্গে বিমানের চুক্তি বাতিলেরও চিন্তাভাবনা করছে। এছাড়া প্রধান কার্যালয়ের পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট জেনারেল ম্যানেজারকেও এই মামলায় অভিযুক্ত করা হবে। বিমানের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, জিএসএ এলাফের নিয়োগ নিয়েও কোটি কোটি টাকার আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়ের অভিযোগ ছিল। কিন্তু তৎকালীণ দুই বোর্ড মেম্বার, বিমানের সাবেক এমডি কেভিন স্টিল ও দুই প্রভাবশালী শীর্ষ কর্মকর্তার যোগসাজস থাকায় এলাফ এভিয়েশনকে তখন জিএসএ থেকে বাদ দেয়া সম্ভব হয়নি।
বিমান সুত্র জানায় জেদ্দার বর্তমান কান্ট্রি ম্যানেজার আবু তাহের কোন ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না। অভিযোগ নামে বেনামে ভুয়া বিল ভাউচার করে তিনি গত ২ বছরে ১শ থেকে দেড়শ কোটি টাকার বেশি লোপাট করেছেন। এছাড়া নির্ধারিত ওজনের অতিরিক্ত ব্যাগেজ বহন করে, বয়স্ক টিকিট ইস্যু করে অপ্রাপ্ত যাত্রীদের বয়স্ক দেখিয়ে, মার্কিন ডলারের পরিবর্তে সৌদি রিয়ালে বিক্রয়কৃত অর্থ স্থানান্তর, বিলম্বিত ফ্লাইটের যাত্রীদের গ্রাউন্ড ফিডিং প্রদান করে, ক্রুদের হোটেল বিলে অনিয়ম করে, দায়িত্বপ্রাপ্ত হ্যান্ডেলিং এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজস করে ব্যাগজ হারানোর কথা বলে যাত্রীদের ভুয়া ক্ষতিপুরণ দিয়ে, ডিপোর্টি প্যাসেঞ্জারদের (গলাকাটা পাসপোর্টে আসা) ভাড়া, অস্থায়ী ও ক্যাজুয়াল ক্রুদের সিঙ্গেল রুম বরাদ্ধ দিয়ে বছরে কোটি কোটি টাকার দুনীতি করছে।
এছাড়া আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ম্যানেজমেন্টের অনুমোদন ছাড়াই সৌদি আরবে চিকিৎসা না করিয়ে ব্যাংককে গিয়ে চিকিৎসার নামে ৩৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী এধরনের ঘটনায় বিমানের চিফ মেডিক্যাল অফিসারের ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু আবু তাহের সেটা না করে এমনকি ছুটি না নিয়ে ব্যাংকক গিয়ে ২ মাসের বেশি সময় অবস্থান করেছেন। এই অভিযোগে বিমান ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্যদ তার বিল আটকে দিলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে জেদ্দাস্থ এলাফ এভিয়েশনের কাছ থেকে পুরো টাকা নিয়ে নেন।
অভিযোগ আছে জিএসএ এলাফকে বিভিন্ন অবৈধ সুযোগ দিয়ে আবু তাহের প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকা মাসোহার নিচ্ছেন। এলাফের সঙ্গে চুক্তিকালীণ সময়ে সিকিউরিটি মানি হিসাবে বিমানের ফান্ডে ১৫ মিলিয়ন রিয়াল অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা জামানত রাখা হয়েছিল। বিমান এই টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে মাসে গড়ে ৩০ লাখ টাকা আয় করতো। কিন্তু আবু তাহের বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই গোপনে সাবেক এমডির সঙ্গে যোগসাজসে জামানতের টাকা ১৫ লাখ থেকে ৫ লাখ কমিয়ে দেয়। অভিযোগ এই খাতে আবু তাহের এলাফের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা মাসোহারা পেয়েছে। এই ঘটনায় বছরে বিমান প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
এই কাজটি করতে আবু তাহের এলাফের পক্ষে যে সব যুক্তি ও তথ্য তুলে ধরেছিল সেগুলোর অধিকাংশই ছিল ভুয়া ও মিথ্যা। আবু তাহেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে তিনি ২০১৪ সালে হজ শেষে মক্কা ও মদিনাতে হাজীদের মালামাল সংগ্রহের জন্য একটি কোম্পানীকে দায়িত্ব দেন। ২০১৩ সালে প্রতিটি লাগেজের ওজন ধরা হয়েছিল ৩০ কেজি। কিন্তু আবু তাহের এবার সেই ওজর বাড়িয়ে ৪০ কেজি করে। এখাতে বিমান প্রায় ৫ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে।
অভিযোগ গত বছর রাস্ট্রপতি আবদুল হামিদ সৌদি সফর কালে জেদ্দা বিমান বন্দরে আবু তাহেরকে পাওয়া যায়নি। এই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেছিল। এছাড়া ফ্লাইট ডিলে‘র তথ্য অগ্রিম না জানানোর কারণে একটি বিশেষ বাহিনীর প্রধান জেদ্দা বিমান বন্দরে এসে ৫ ঘন্টার উপরে বসা ছিলেন। এই সময় আবু তাহেরকে টেলিফোন করেও কোথাও পাওয়া যায়নি। এই ঘটনায়ও আবু তাহেরকে শোকজ করা হয়। জানাগেছে আবু তাহের এতটাই প্রভাবশালী তার বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ থাকলেও তাকে জেদ্দা স্টেশন থেকে দীর্ঘদিন ধরে সরানো হচ্ছে না।
একই অভিযোগ আছে দুবাইয়ের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ এহসান হোসেন কাজী, নিউইয়র্কের কান্ট্রি ম্যানেজার আশরাফ হোসেন, নেপালের কান্ট্রি ম্যানেজার মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে। দুবাইয়ের কান্ট্রি ম্যানেজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সেখানে বিমানের কাজ না করে ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করছেন। তার বরুদ্ধে কমপক্ষে ২শ কোটি টাকার বেশি দুনীতির অভিযোগ আছে। কিন্তু এসব অভিযোগের কোন তদন্ত করছে না বিমান। অপর দিকে ঢাকা নিউইয়র্কের কোন ফ্লাইট না থাকলেও গত ৫ বছর ধরে আশরাফ হোসেনকে নিউইয়র্কের কান্ট্রি ম্যানেজার করে বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতা দিয়ে আসছে বিমান।
বিমানের মার্কেটিং বিভাগ সুত্রে জানাগেছে, অদক্ষ, অযোগ্য ও দুনীতিগ্রস্থ জেনারেল সেল্স এজেন্টের (জিএসএ) কারণে গত ৫ বছরে শুধু জেদ্দা ও লন্ডনের দুটি রুট চালিয়ে বিমান লোকসান গুনছে ৯শ কোটি টাকার বেশি। জেদ্দার জিএসএস‘র বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা বিমানের নামে যাত্রী সংগ্রহ করে শেষ মুহুর্তে মোটা অংকের টাকা নিয়ে সেসব যাত্রী অন্য এয়ারলাইন্সের কাছে বিক্রি করে দিতো। এতে আগে প্রায়শ বিমানের জেদ্দা-ঢাকার ফ্লাইটগুলোকে খালি আসতো। বিমানের শীর্ষ ম্যানেজমেন্টের একজন সদস্য (সাবেক মার্কেটিং কর্মকর্তা) ও মার্কেটিং বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা মিলে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রতি মাসে ওই টাকার ভাগ পেতো বলে এনিয়ে কোন টু শব্দ হতো না।
উপরোন্ত মোটা অংকের টাকা নিয়ে গোপনে প্রতি বছর ওই জিএসএ‘র চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল। হিসাব অনুযায়ী ২০১২-১৩ সালে বিমান ঢাকা-লন্ডন-রোম-মিলানসহ পুরো ইউরোপ রুটে লোকসান দিয়েছে ২৩ হাজার ২২৩ লাখ টাকা অর্থাৎ ২৩২ কোটি টাকা। অপর দিকে ঢাকা-জেদ্দা-রিয়াদসহ পুরো মধ্য প্রাচ্যে ফ্লাইট চালিয়ে বিমানকে লোকসান গুনতে হয়েছে ৩৯৪ কোটি টাকা। তবে মার্কেটিং সুত্রে জানাগেছে গত ২/৩ মাস ধরে বিমানের লন্ডন ও জেদ্দা রুটে লাভ হচ্ছে। অভিযোগ রযেছে জেদ্দার এলাফ এভিয়েশনের সঙ্গে বিমানের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও প্রায় এক বছর কোন ধরনের চুক্তি ছাড়াই তারা বেআইনী ভাবে টিকিট বিক্রি করেছে। মার্কেটিং বিভাগের পরিচালক শাহনেওয়াজ জানান, বিভিণœ অভিযোগে লন্ডনের কার্গো জিএসএ আনা এভিয়েশনকে বাদ দিলেও জেদ্দার এলাফ এভিয়েশনকে বাদ দেয়া সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে জানাগেছে জেদ্দার বর্তমান জিএসএ এলাফের সঙ্গে অসংখ্য এয়ারলাইন্সের ব্যবসা রয়েছে। যার কারণে তারা বিমানের টিকিট বিক্রির প্রতি তেমন মনোযোগী নয়। এছাড়া প্রায়‘শ তারা বিমানের পরিবর্তে অন্য এয়ালাইন্সকে বেশি যাত্রী দিচ্ছে। সুত্র জানায় জেদ্দার বর্তমান জিএসএ‘র অধিকাংশ স্টাফ হচ্ছে পাকিস্তানের নাগরিক। এর আগে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ওই জিএসএ‘র কর্মকান্ডগুলো কঠোর মনিটরিং করার জন্য বিমানকে রিপোর্ট দিয়েছিল। কিন্তু বিমানের মার্কেটিং বিভাগ এ বিষয়ে কোন পাত্তা দেয়নি। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এয়ারলাইন্স ব্যবসায় জিএসএ অপারেটররা খুবই গুরুত্বপুর্ণ। ভুলের কারণে কোন ধরনের অপরাধী টিকিট কিনে বিমানে অবতরণ করে থাকেন তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা থাকে।
এ প্রসঙ্গে বিমান পরিচালণা পর্যদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, বলেন, তিনি এখনো অফিসিয়ালী বিমানের চেয়ারম্যান নন। কাজেই এই মুহুর্তে কিছু বলতে পারবেন না। তবে চেয়ারম্যান থাকাকালীণ জিএসএ নিয়োগের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেন, আগে বছরের পর বছর বিমানের জিএসএ অপারেটরদের চুক্তি শেষে শুধু নবায়ন করা হতো। কোন টেন্ডার আহবান করা হতো না। তার নির্দেশনার পর এখন মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে টেন্ডার আহবান করা হচ্ছে। এতে বিমান বড় ধরনের লাভবান হচ্ছে। দুনীতি জেদ্দার স্টেশন ম্যানেজার আবু তাহেরে সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ খন্ডন করা হযেছে।
– মুজিব মাসুদ