রাঙ্গা প্রভাতে সোনার চালান পূর্ব পরিকল্পিত ছিল

Goldএভিয়েশন নিউজ: বিমানের যে ফ্লাইটে সোমবার ৬১ কেজি সোনা ধরা হয়, সেটা কখন-কোথায়- কিভাবে ল্যান্ড করবে, কোথায় মাল খালাস করা হবে, কে-কিভাবে কতটুকু সহায়তা করবে সবই ছিল পরিকল্পিত। যাত্রীরা নেমে যাবার পর কত দ্রুত সে ফ্লাইট যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে হ্যাঙ্গারে নেয়া হতো সেটাও আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্য, চোরাচালানীদের তার আগেই কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স করে সব ভন্ডুল করে দেয়া হয়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আগামী দশ কার্যদিবসের মধ্যে এ কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের পর থানায় মামলা দায়ের করা হবে।

মঙ্গলবার দুপুরে বিমান হ্যাঙ্গার, সিভিল এ্যাভিয়েশন ও বিমানের নিরাপত্তা শাখায় আলাপ করে জানা যায়, ২৩ জনের একটি সিন্ডিকেট ওই চালান খালাস করার জন্য প্রস্তুত। তাদের মধ্যে ১২ জন বিমান প্রকৌশলী শাখার, ৬ জন নিরাপত্তা শাখার, ৪ জন কেবিন ক্রু, ৫ জন একটি গোয়েন্দা সংস্থার, ৬ জন সিভিল এ্যাভিয়েশান শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল। তারা নিজ নিজ পয়েন্টে সোনার চালান খালাস করার কাজে সহায়তা করত। সিন্ডিকেটের এ ৩৩ সদস্যের জন্য বাজেট ছিল ৮০ লাখ টাকা।

কিভাবে খালাস করা হতো জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী ওই ফ্লাইটের সব যাত্রী নেমে যাবার পর সেটা নিয়ে যাওয়া হতো বিমানের নিজস্ব হ্যাঙ্গারে। সেখানে দুই দিনব্যাপী আলফা চেক করা হতো। ওই সময় সোনা বের করে নিরাপদে পাচার করা হতো বাইরে।

আলফা চেকের সঙ্গে সোনার চালানের যোগসূত্র থাকার উপায় কি জানতে চাইলে-বিমানের এক প্রকৌশলী বলেন-রাঙ্গা প্রভাত উড়োজাহাজটি নতুন বোয়িং ৭৭৭। বোয়িং কোম্পানির রুলস অনুযায়ী প্রতি ৮০০ ঘণ্টা ওড়ার পর এটি নিয়মিত চেক করা বাধ্যতামূলক। সে বাধ্যবাধকতার জন্যই ওই উড়োজাহাজটি অন্তত এক সপ্তাহ আগেই আলফা চেকের জন্য সোমবারের তারিখ নির্ধারিত ছিল। চোরাচালানিরা এটা ভাল করে নিশ্চিত হয়েই সেভাবেই পরিকল্পনা করে। আলফা চেকের সময়সূচী ঠিক করে প্রকৌশল পরিকল্পনা শাখা। চোরাচালানীরা এখানেও তাদের সিন্ডিকেট সদস্যকে নিয়োজিত করে থাকে।

রাঙ্গা প্রভাতের মতো উড়োজাহাজের আলফা চেকের সময় জনাবিশেক প্রকৌশলী ছাড়াও মেকানিক, ক্লিনারসহ কমপক্ষে জনাপঞ্চাশেক জনবল দরকার। এদের মধ্যেই হয়ত হাতেগোনা কয়েকজন এমন চোরাচালানের সঙ্গে সক্রিয় থাকে।

সূত্র জানায়, প্রকৌশল শাখা থেকে সোনা বের করার পর সেটা তো হ্যাঙ্গার গেট দিয়েই বাইরে পাঠানো হতো। তাহলে ওই গেটের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজনের যোগসাজশ ছাড়া কিছুতেই চালান বাইরে নেয়া সম্ভব নয়। মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওই গেটে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে সিভিল এ্যাভিয়েশনের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী, বিমানের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী, কাস্টমসের কর্মী ও আর্মড পুলিশের সদস্য।

এতগুলো সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে সোনার চালান বের করা সম্ভব হয় জানতে চাইলে এক প্রকৌশলী জানান-যোগসাজশ থাকলেই কেবল সম্ভব। কারণ, এ গেটের চৌকস ও অভিজ্ঞ নিরাপত্তাকর্মীদের ফাঁকি দিয়ে সোনা বের করা সম্ভব নয়।
এদিকে কেন বোর্ডিংব্রিজে ল্যান্ড না করে বে-স্ট্যান্ডে ওই ফ্লাইট রাখা হলো, এ নিয়েও ধুয়াশা কাটছে না। বিমান ও সিভিল এ্যাভিয়েশান বলছে পরস্পরবিরোধী কথা।

এ সম্পর্কে বিমান বলছে কোন্ ফ্লাইট কোথায়-কখন ল্যান্ড করবে সেটা ঠিক করে সিভিল এ্যাভিয়েশন নিয়ন্ত্রিত স্টেশন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার (স্যাটো)। তাদের নির্দেশ ছাড়া সম্ভব নয় কোন জাহাজ নিজস্ব এখতিয়ারে বিমানব্দরের কোথাও অবস্থান করা । তাহলে কি স্যাটোর লোকও এ সিন্ডিকেটের সদস্য। এমন অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিভিল এ্যাভিয়েশনের এক পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন-মঙ্গলবার সকালে রাঙ্গা প্রভাত ল্যান্ড করার আগে-পরে বিমানের অপারেশন থেকে অনুরোধ করা হয় যাতে ওটা বোডির্ংব্রিজের পরিবর্তে বে-স্ট্যান্ডে পার্ক করা হয়। বিমানের চালক সেভাবেই সেটা অনুসরণ করেন।

এ বিষয়ে জানা যায়, শাহজালালে মোট ৮ বোর্ডিব্রিজ রয়েছে। তার মধ্যে তিনটা ছিল মেরামতের কাজে অচল। বাকি ৫টায় বিদেশী এয়ারলাইন্সকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। মঙ্গলবার সকালের কয়েকটা ফ্লাইট একত্রে নামে। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তুু বিমানের মতো এয়ারলাইন্সের একটি সুপরিসর উড়োজাহাজকে বোর্ডিংব্রিজে ল্যান্ডিং না দিয়ে আউটস্ট্যান্ডে রাখাটা রহস্যজনক। এখানেই ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’ বলা যেতে পারে।

এদিকে বিমানের ফ্লাইটের টয়লেটের ভেতর থেকে এত বিশাল সোনার চালান ধরা পড়ায় বিস্মিত হয়েছেন বিদেশী এমডি কাইল হেয়্যুদ। তিনি মঙ্গলবার সকালে বিদেশ থেকে এসেই ছুটে গেছেন বিমানের প্রকৌশল শাখায়। সেখানকার পারিপার্শিতা দেখেন। সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে আলাপ করেন। তারপর ছুটে যান সিভিল এ্যাভিয়েশনে। সেখানে চোরাচালান নিয়ে সমন্বিত বৈঠক করেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন।

তার পক্ষে বিমানের জনসংযোগ শাখা থেকে বলা হয়, এ জাতীয় চোরাচালান দুঃখজনক। কিছুতেই এটা বরদাশত করার মতো নয়। এ জাতীয় চোরাচালান প্রতিরোধে বিমান, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও সিভিল এ্যাভিয়েশনের সঙ্গে সমন্বিত পদক্ষেপ নেবে। চোরাচালানীদের চিহ্নিত করতে তদন্তে সহায়তা করা হবে।

জানতে চাইলে বিমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন বলেন, “সোনার গডফাদাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিমানের যোগসাজশ ছাড়া এ জাতীয় ঘটনা সম্ভব নয়। বিমান অতীতেও এ জাতীয় ঘটনায় জড়িতদের বিরু্েদ্ব ব্যবস্থা নিয়েছে। ভবিষ্যতেও নেবে। ইতোমধ্যে বিমানের কয়েক কর্মকর্তার গতিবিধি নজরদারি করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান বলেন-যেভাবে বিমানের টয়লেটে সোনার বারগুলো লুকানো ছিল তা কিছুতেই যাত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়। এটা টেকনিক্যাল এ্যাক্ট। কাজেই এটা সুস্পষ্ট, বিমানের প্রকৌশল শাখার লোকজনের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয় এভাবে সোনা ঢুকানো ও বের করা। তিনি বলেন-এ বিষয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি আগামী দশ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে। তারপর মামলা হবে।

সূত্র জানায়-এবার বিমানের আরও অনেক বড় কর্মকর্তার নাম শোনা যাচ্ছে। তদন্তে প্রমাণিত হলো, আরও দুজন পাইলটসহ অনেক বড় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। আটক করা হবে। তখন থলের বিড়াল বের হয়ে আসবে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.