সিসি ক্যামেরাগুলোর অবস্থান বুঝে খুনিরা আড়ালে থেকেই চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যা করে বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।ঘটনাস্থল ও আর নিজাম রোডের যে স্থানটিতে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তার আশপাশের সিসি ক্যামেরাগুলোর ফুটেজে স্পষ্ট অবয়ব ধরা না পড়ায় এই সন্দেহ করছেন তারা।
এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ফুটেজ পর্যালোচনা ও আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে মিতুর উপর হামলা করা হয়েছে।
“ক্যামেরার অদূরে থেকে মিতুর ওপর হামলায় অংশ নেয় হত্যাকারীরা। যে স্থানে হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেখানে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না এবং আশপাশের ভবন থেকে সংগ্রহ করা ফুটেজেও তাদের অবয়ব স্পষ্ট নয়।”
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্বে থাকার সময় অপরাধ ঠেকাতে বন্দর নগরীর বিভিন্ন স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপনে উদ্যোগী ছিলেন বাবুল।
সম্প্রতি তিনি ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি হলেও স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু দুই সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রামেই ছিলেন।
রোববার সকালে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে নগরীর জিইসি মোড়ে যাওয়ার সময় খুন হন চট্টগ্রামে জঙ্গি দমনে বেশ কয়েকটি অভিযানে নেতৃত্বদাতা পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের স্ত্রী।
হত্যাকাণ্ডস্থলের কাছের একটি সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। এতে খুনের দৃশ্য বৈদ্যুতিক খুঁটিতে আড়াল হলেও তিনজনকে একটি মোটর সাইকেলে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
ঘটনার দিন রাতে ওই মোটর সাইকেলটি পুলিশ পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করলেও দুই দিনেও কোনো খুনিকে শনাক্ত করতে পারেনি। চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা জানালেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে রাস্তার বিপরীত থেকে দ্রুতগতিতে হেঁটে যেতে জিন্স প্যান্ট ও চেক শার্ট পরা এক যুবককে দেখা যায়। যুবকটিও হামলায় অংশ নিয়ে মোটর সাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ভোর ৫টা ৭ মিনিট থেকে ওই যুবকটি ৬টা ৩২ মিনিট পর্যন্ত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গলির মুখে অবস্থান নিয়ে ছিল। বিপরীত দিকের রাস্তা থেকে মিতুকে আসতে দেখে সে দ্রুত গতিতে হেঁটে যায় এবং হামলায় অংশ নেয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা, সিসি ক্যামেরা থেকে আড়ালে থাকার জন্য ওয়েল ফুড ও ও আর নিজাম রোড আবাসিক এলাকার মাঝামাঝি স্থানটিকে হামলার জন্য বেছে নেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার সোমবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “সংগ্রহ করা সিসি ক্যামেরার ছবিগুলো খুব বেশি স্পষ্ট নয়।”
তবে তিনি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, “শুধু সিসি ক্যামেরার ফুটেজই তদন্তের ভরসা নয়। অনেক স্থানের ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। হত্যাকারীদের স্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ ছবি খোঁজা হচ্ছে।”
মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত করে মোটর সাইকেল নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ওই রাস্তা অতিক্রম করা কালো রংয়ের মাইক্রোবাসটি হত্যাকারীদের ‘ব্যাকআপ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
সিএমপির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কালো রঙের মাইক্রোবাসটি ৬টা ৩৮ মিনিটে প্রবর্ত্তক মোড় থেকে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে ষোলশহরের দিকে যাওয়ার এবং ৬টা ৪৩ মিনিটে বহদ্দারহাট থেকে বাদুরতলার দিকে যাওয়ার ছবি দেখা গেছে।
মোটর সাইকেল আরোহীরা পাঁচলাইশ হয়ে বাদুরতলা বড় গ্যারেজ এলাকায় মোটর সাইকেলটি রাখার পর মাইক্রোবাসটি তাদের তুলে নেয় বলে ধারণা করছে পুলিশ। সেখানেই মোটর সাইকেলটি পায় পুলিশ।
পুলিশ কমিশনার ইকবাল বলেন, “হত্যাকারীদের সঙ্গে এ মাইক্রোবাসের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। ব্যাক-আপ হিসেবে এটি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সোমবার এসপি বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পাশাপাশি পুলিশের সবকটি বিভাগ মামলাটির তদন্ত কাজে যুক্ত হয়েছে।
তদন্তে অগ্রগতি নেই
সহকর্মীর স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের ৬০ ঘণ্টা পেরুলেও তদন্তে অগ্রগতির কোনো খবর জানাতে পারেনি পুলিশ।
সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার মঙ্গলবার রাতে বলেন, “বলবার মতো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।”
তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “সবদিক বিশ্লেষণ করে মূল জায়গায় আঘাত হানতে একটু সময় নিচ্ছি। চেষ্টায় আছি মূল জায়গায় যেতে।”
ওই মোটর সাইকেলের প্রকৃত মালিক দেলোয়ারকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তবে তার নামে কাগজপত্র থাকলেও তিনি ২০১১ সালে এটি অন্যজনের কাছে বিক্রি করে দেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।
জেএমবি সংশ্লিষ্টতাকে প্রাধান্য দিলেও এতে জামায়াত-শিবির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখার কথা পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে জামায়াত দাবি করেছে, কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ডে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
জামায়াতকে সন্দেহের কারণ হিসেবে পুলিশ কমিশনার বলছেন, “জেএমবির অনেকেই সাবেক শিবির। আর যে এলাকা থেকে হত্যায় ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি উদ্ধার হয়েছে, তা শিবির অধ্যুষিত।”
এছাড়া আর কারও সম্পৃক্ততা খুঁজে দেখা হচ্ছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সমস্ত অপশনই আমরা এক্সারসাইজ করছি।”
গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করলেও পুলিশের সব সংস্থাই সহকর্মী খুনের ঘটনাটির রহস্যভেদে কাজ করছে।
মঙ্গলবার পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের তিন সদস্যের একটি দল চট্টগ্রামে এসেছে। এছাড়া পিবিআই, সিআইডিও কাজ করছে।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম মঙ্গলবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা অপরাধ সংঘটন প্রক্রিয়া নিয়ে তদন্ত করছি। ভিক্টিমের (মিতু) প্রোফাইল নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করা হচ্ছে।”
এ খুনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বিদেশি, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও খ্রিস্টান যাজক হত্যাকাণ্ডের মিল রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ, যেগুলোতে জঙ্গিরাই মূল সন্দেহভাজন।
জঙ্গি দমনে বাবুল আক্তারের সাহসিকতাপূর্ণ ভূমিকাই এই হত্যাকাণ্ডের কারণ বলে মনে করছেন মনিরুলও।
“বাবুল আক্তারের কারণে তার স্ত্রী ভিক্টিম হয়েছে বলে আমরা মনে করি। কারণ বাবুল আক্তারের দায়িত্ব ও কর্মকাণ্ড জঙ্গিবিরোধী ছিল।”
সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, “আমরা সব তথ্য খতিয়ে দেখছি। সব তথ্য নিয়ে একটা অবস্থানে না যাওয়া পর্যন্ত খোলাসা করা যাবে না।”