ফাইল আটকে ঘুষ বাণিজ্য ও বিমানবন্দরের ১২ মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) পরিচালকসহ ১০ জনের নথি তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের মধ্যে পরিচালক প্রশাসন গৌতম কুমার ভট্টাচার্য, নির্বাহী প্রকৌশলী আছির উদ্দিন, সহকারী প্রকৌশলী মুরাদ হোসেন, ঠিকাদার সাহাবউদ্দিন, রোজ বাচ্চু, বাউনিয়া জাহাঙ্গীর অন্যতম। এছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগে সিভিল এভিয়েশনের দৈনিক ভিত্তিতে (ক্যাজুয়াল) নিয়োগপ্রাপ্ত নিরাপত্তা অধিক্ষক মাকসুদ তালুকদার ও অসিয়ত জামানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক।
দুদকের উপপরিচালক হেলাল উদ্দিন শরীফের স্বাক্ষরে ৯ জুন এক চিঠিতে এসব নথি তলব করা হয়। চিঠিতে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা চাকরি শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত যেসব স্টেশনে ছিলেন তার সময়কালসহ বিস্তারিত তথ্য দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে তাদের পদোন্নতি সংক্রান্ত যেসব প্রজ্ঞাপন ও নথি জারি হয়েছে তার সত্যায়িত ফটোকপি চাওয়া হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য বেবিচক থেকে দাখিলকৃত সম্পদের বিবরণীর সত্যায়িত ফটোকপিও দিতে বলা হয়েছে চিঠিতে। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গণি চৌধুরীর কাছে লেখা চিঠিতে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান ও ১২টি প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি হয়েছে কিনা এবং এর সঙ্গে বেবিচক ও সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে। দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২ এর উপপরিচালক হেলাল উদ্দিন শরীফ এ অনুসন্ধান করবেন। বিমানবন্দরের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালে বিনা টেন্ডারে ১৬ কোটি টাকার কাজ, ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম স্থাপন, সাব স্টেশনে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট ও প্যানেল বোর্ড স্থাপন, বোর্ডিং ব্রিজের স্পেয়ার পার্টস ক্রয়, সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনের বিভিন্ন কাজ, চিলার প্লান্টের বিভিন্ন কাজ, মেইন পাওয়ার প্লান্টের কাজ, গার্ডেন লাইট স্থাপন, সৌর প্যানেল স্থাপন, চায়নার তৈরি ২০টি মাস্টলাইট ক্রয়, বিমানবন্দরে আন্ডার গ্রাউন্ড পাওয়ার ক্যাবল স্থাপন, ফ্লোর মাউন্টের প্যানেল বোর্ড স্থাপন, ওয়াল মাউন্টের প্যানেল বোর্ড স্থাপন, জেনারেটর স্থাপন অন্যতম। দুদকের চিঠিতে এসব প্রকল্পের যাবতীয় নথি, স্টক রেজিস্ট্রার, বণ্টন রেজিস্ট্রার, ঠিকাদারদের নাম, টেন্ডার ডুকুমেন্ট, কাজের মূল্যায়নপত্র, ব্যয় মঞ্জুরি, বিল প্রদানসহ যাবতীয় কাগজপত্রের সত্যায়িত কপি প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। দুদক সূত্রে আরও জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের আওতাধীন বিভিন্ন বিমানবন্দরের বড় বড় প্রকল্পের কাজ বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমোদন সাপেক্ষে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে হয়। এসব কাজে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বড় অংকের টাকা ঘুষ দিতে হয় বলেও তাদের কাছে অভিযোগ আছে। শিগগির এ বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু হবে।
সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের একজন সহকারী প্রধানের তত্ত্বাবধানে এসব প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাতে হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে, সংশ্লিষ্ট শাখার ওই সহকারী প্রধানকে ২ শতাংশ কমিশন না দিলে তিনি কোনো ফাইলই পাঠান না। উল্টো সেগুলো বেবিচকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে অন্যতম বড় প্রকল্পগুলো হল চট্টগ্রাম ও শাহজালালের রানওয়ে কার্পেটিং, শাহজালালের রানওয়ে এক্সটেনশন, অ্যাপ্রোন এক্সটেনশন ও থার্ড টার্মিনাল স্থাপন অন্যতম। সূত্র জানায়, এ অভিযোগগুলোর বিষয়ে প্রাথমিক তদন্ত চলছে। তদন্তে যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে একজন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে।
সম্প্রতি বেবিচকের ইএম (ইলেকট্রিক অ্যান্ড মেকানিক্যাল) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে ফাইল আটকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবির অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী আছির উদ্দিনকে সম্প্রতি কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর সরবরাহ কাজে অনিয়ম তদন্তের জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) নিযুক্ত করা হয়। অভিযোগ আছে, তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে আছির উদ্দিন জাল ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে সংশ্লিষ্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে ঘুষ দাবি করে চিঠি দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আছিরের বিরুদ্ধে বেবিচক চেয়ারম্যানকে লিখিত অভিযোগ দেয়। চিঠিতে তারা বলে, নির্বাহী প্রকৌশলী আছির উদ্দিন তাদের ফার্মের নামে ভুয়া ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল। ফাইল আটকে ভালো তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার কথা বলে তাদের কাছে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিল। কিন্তু আছির উদ্দিনের এ আহ্বানে তারা সাড়া দেয়নি। আছিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের জহুরা মার্কেটের সামনে এবং ১৪ নম্বর সেক্টরে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছেন।
এ ঘটনায় বেবিচক থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি আছিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে রিপোর্ট প্রদান করলেও সে রিপোর্ট দীর্ঘদিন ধরে আটকে রাখেন পরিচালক প্রশাসন গৌতম কুমার ভট্টাচার্য। দুদকের চিঠিতে পরিচালক প্রশাসন গৌতম কুমারেরও চাকরি সংক্রান্ত ব্যক্তি নথি, শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত যেসব স্টেশনে চাকরি করেছেন তার বিবরণ, পদোন্নতির কাগজ ও সম্পদ বিবরণীর দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।
অপরদিকে সহকারী প্রকৌশলী মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে ইএম বিভাগের সংশ্লিষ্ট প্রকল্প তৈরি ও এ খাতে ঠিকাদারদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। ২৭ বছর ধরে তিনি একই পোস্ট এবং একই জায়গায় কাজ করছেন। সম্প্রতি তাকে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে স্ট্যান্ডরিলিজ করা হলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে সে আদেশ বাতিল করান। মুরাদ হোসেন এতটাই প্রভাবশালী, তিনি সিভিল এভিয়েশনের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও তোয়াক্কা করেন না। চাকরিকালীন তিনি নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে।
অপরদিকে দুদকের কাছে অভিযোগ আছে, পরপর দুই দফা চাকরিচ্যুত হওয়া এক নিরাপত্তা অপারেটরকে মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে আবারও নিয়োগ দিয়েছে বেবিচক। বেবিচকের একটি সিন্ডিকেট ২৫ এপ্রিল এ নিরাপত্তাকর্মীকে দৈনিক ভিত্তিতে (ক্যাজুয়াল) নিয়োগ প্রদান করে। ওই সিন্ডিকেট এখন তাকে আবার জ্যেষ্ঠ কর্মী হিসেবে স্থায়ী করারও পাঁয়তারা করছে। এই কর্মচারীর নাম মাকসুদ তালুকদার। ২০০২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি বেবিচকে যোগদান করেন। এরপর বৈদেশিক মুদ্রা পাচারকালীন বিমানবন্দর মেজিস্ট্রেটের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে। এরপর দীর্ঘ তদন্ত সাপেক্ষে তাকে ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৪ সালের ২৮ মে বিশিষ্ট নিউরোলজিস্ট ডা. দীন মোহাম্মদের লাগেজ কেটে মালামাল চুরি ও তার কাছ থেকে জোরপূর্বক ৫০০ ডলার হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে আবারও চাকরিচ্যুত হয় মাকসুদ তালুকদার। সিসি টিভির ফুটেজ দেখে সিভিল এভিয়েশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ হোসেনের নির্দেশে তদন্ত সাপেক্ষে তাকে চাকরি থেকে দ্বিতীয় দফা বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে, মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি ২৫ এপ্রিল আবারও চাকরি পান। একই সঙ্গে বিমানবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর তথ্য গোপন করে সিভিল এভিয়েশনে ক্যাজুয়াল নিরাপত্তা অপারেটর হিসেবে যোগদান করেন অসিয়ত জামান। সম্প্রতি তিনিও মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি স্থায়ী করার পাঁয়তারা করছেন। যদিও আইনে আছে, একজন ব্যক্তি কোনোভাবে দুইবার সরকারি চাকরি করতে পারবেন না।
সূত্রঃ যুগান্তর