রাজধানীতে সবচেয়ে স্পর্শকাতর এলাকা হলো কূটনৈতিক পাড়াখ্যাত গুলশান। অতীতে কয়েকটি সন্ত্রাসী আক্রমণ এবং অতি সম্প্রতি হলি আর্টিসান বেকারি রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
এই এলাকায় বিদেশি কূটনীতিকদের বাস। এ কারণে এখানে নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ে। বিদেশি বিনিয়োগ এবং রপ্তানি অর্থনীতিও হুমকির মুখোমুখি হয়। হলি আর্টিসানে হামলার জেরে এখন সে আশঙ্কাই তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। পোশাক শিল্পের বিদেশি ক্রেতারা আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত বিদেশি এনজিওগুলোও কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেয়ার চিন্তা করছে।
অথচ এই এলাকাতে যত্রতত্র অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ, স্পা সেন্টার, স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও রাজনৈতিক কার্যালয়। এমন একটি স্পর্শকাতর এলাকায় কী করে এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে তার কোনো উত্তর নেই। এই পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনের গাফিলতি এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ঔদাসীন্যকেই দায়ী করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়তই অসংখ্য মানুষের আনাগোনা থাকে। ফলে অপরাধীদের আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন।
আর এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা কূটনৈতিক এলাকায় একের পর এক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্যাটি স্বীকার করে অবশেষে গত শনিবার (৪ জুলাই) গুলশান আবাসিক এলাকায় অবৈধ রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গুলশানের পাশাপাশি বনানী ও বারিধারার আবাসিক এলাকায়ও অনুমোদনহীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে।
গুলশান কূটনৈতিক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আবাসিক এলাকার প্লটগুলোর বেজমেন্ট গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখার কথা থাকলেও সেখানে গড়ে উঠেছে রেস্তোরাঁ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শপিং মলসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।
গুলশান ২ এর ৭১ নম্বর রোডে মালয়েশিয়া দূতাবাসের ঠিক বিপরীত পাশে রয়েছে ‘এমানুলস রেস্টুরেন্ট’। একই রোডে খানিকটা সামনে ‘অরোরা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’। এছাড়া রয়েছে ‘সই ৭১’ ও ‘গ্লোরিয়া জিনস্ কফি’ নামের আরও দুটি রেস্টুরেন্ট। পাকিস্তান দূতাবাসের পাশে আছে স্কলাস্টিকা স্কুলের জুনিয়র ক্যাম্পাস। ৭১ নম্বর সড়কের লেক ঘেঁষে রয়েছে ‘ইউনাইটেড হাসপাতাল’।
৭৯ নম্বর রোড়ে রুশ দূতাবাসের পাশে রয়েছে ‘ম্যারাকি রেস্টুরেন্ট’। ৮৪ নম্বর সড়কে অস্ট্রেলিয়ান দূতাবাসের কাছেই ‘গ্রিন ডেইল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’। এছাড়া একই সড়কে রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্যালয়। পাশে আছে ‘অস্ট্রেলিয়া ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’। সৌদি দূতাবাসের পাশে রয়েছে ‘চিটাগাং গ্রামার স্কুল’।
স্পেন দূতাবাসের রাস্তার ওপারেই রয়েছে ইউনিমার্টের শপিং মল। ৮৬ নম্বর সড়কে আছে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় ও গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
গুলশান কূটনৈতিক এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কারণে অসংখ্য বহিরাগতের আসা যাওয়া থাকে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দাবি, কূটনৈতিক এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। তল্লাশি চৌকি বাড়ানো হয়েছে, সিসিটিভিতে চলাচলকারীদের গতিবিধি দেখা হচ্ছে। প্রবেশমুখে নিরাপত্তার খাতিরে তল্লাশি চলছে। কিন্তু এখানে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বহুলোকের আনাগোনার কারণে সবাইকে তল্লাশির আওতায় আনা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, সন্ত্রাসীরা অনেককিছু বিবেচনা করে এই এলাকাটি বেছে নিয়েছে। নানা মানুষের আসা যাওয়ার সুযোগটাই তারা গ্রহণ করে নিরাপত্তাকর্মীদের ফাঁক গলিয়ে এই সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে। কূটনৈতিক এলাকায় অবৈধভাবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা অবশ্যই নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। সরকার এগুলো সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যত দ্রুত সরানো হবে সার্বিক নিরাপত্তা তত দ্রুত নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
তবে স্পর্শকাতর জেনেও এই এলাকায় নিরাপত্তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কথাই জানালেন গুলশান সোসাইটির প্রেসিডেন্ট, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম সামছুল হুদা। তিনি বলেন, গুলশান সোসাইটি অনেকদিন ধরেই এগুলো সরানোর চেষ্টা চালাচ্ছি। আমাদেরতো আসলে সরিয়ে দেয়ার অধিকার নেই। এখন ডিপেন্ড করতে হচ্ছে রাজউক ও সিটি করপোরেশনের ওপর। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বাস্তবায়নও তারাই করবেন। আমাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশন ও রাজউকের দুইটা মিটিং ইতিমধ্যে হয়েছে। মেয়র ও গণপূর্তমন্ত্রী এসেছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। অবৈধ প্রতিষ্ঠান সরানোর ব্যাপারে সরকারকে সবধরনের সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত আছি।
আগে থেকে সতর্ক না হওয়ার কারণেই যে গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি রেস্টুরেন্টে এতো বড় সন্ত্রাসী হামলার ঘট্না ঘটতে পারলো এবং এরপরই প্রশাসনের টনক নড়লো তা বুঝা যায় গুলশান কূটনৈতিক জোনের ডিসি জসিম উদ্দিনের বক্তব্যেই। তিনি বলেন, কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তা অন্য যেকোনো সময়ের থেকে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখানে পুলিশ, আর্মড পুলিশ ও ইন্টিলিজেন্সের সদস্যদের দারুণ এক সমন্বয় করা হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
তবে অবৈধ রেস্টুরেন্ট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা থাকছেই। কারণ এরকম একটি অভিজাত এলাকায় যারা হোটেল, রেস্টুরেন্ট, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক কার্যালয় খুলে বসেছেন তারা কেউই কম প্রভাবশালী নন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নিয়ে অন্য অনেক সমস্যার মতো প্রশাসনে একে অপরের ওপর দায় চাপানোর ঘ্টনা যে ঘটবে না তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না।
অবৈধ প্রতিষ্ঠান সরানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিসি জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা মূলত কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছি। আর এ ব্যাপারটা দেখবে গুলশান ক্রাইম ডিভিশন।
গুলশান এলাকা স্বাভাবিক হতে কতদিন সময় লাগতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা একটা মনস্তাত্বিক বিষয়। নরমালি অধিকাংশ ঈদের ছুটিতে গেছে। তারা ফিরতে শুরু করেছেন। ক্রমেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারি রেস্তোরাঁয় গত শুক্রবার (১ জুলাই) রাত পৌনে ৯টার দিকে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী ঢুকে দেশি-বিদেশিদের জিম্মি করে। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর শনিবার সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযানে ১৩ জন জিম্মিকে জীবিত উদ্ধার এবং ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহতদের মধ্যে ১৭ জনই বিদেশি নাগরিক। অভিযানে পাঁচ সন্ত্রাসীও নিহত হয়।
এর আগে ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই এলাকায় তাভেল্লা সিজার নামের একজন ইতালীয় নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।