সিটিসেলের নিকট ভবিষ্যৎ নিয়ে সংকায় রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। নিজেদের কী করা উচিৎ তা বুঝে উঠতে পারছেন না কেউই। বেতন ছাড়া প্রায় ৬০০ কর্মীর পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের করণীয় ঠিক করতে বিটিআরসি চেয়ারম্যানের কাছে পত্র লিখেছেন প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিঃ এমপ্লয়ীজ ইউনিয়নের সভাপতি আশরাফুল করিম। গত ১ আগস্ট পত্রটি গ্রহণ করেছে বিটিআরসি। পাঠকদের জন্য পত্রটি হুবহু প্রকাশ করা হলো –
মহোদয়, যথাবিহীত সম্মান পূর্বক নিবেদন এই যে, আমরা প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিঃ (সিটিসেল) এর কর্মচারীবৃন্দ দীর্ঘদিন যাবৎ মানবেতর জীবন-যাপন করে আসছি। নিতান্তই নিরুপায় হয়ে আজ আমাদের আর্তি আপনাদের কাছে লিখিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
আপনারা অবগত আছেন যে, প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিঃ (সিটিসেল) বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। একটা সময় ছিল যখন আমরা সিটিসেলে চাকুরী করে গর্ববোধ করতাম।২০১০ সাল পর্যন্ত সিটিসেলের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব/আয় ছিল। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকেই কোন এক অবোধ্য কারণে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়ের পতন শুরু হয়। গ্রাহক সংখ্যা দ্রুত কমতে থাকলো, সেই সাথে কমতে থাকলো মুনাফা এবং পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকলো অর্থনৈতিক ক্ষতি। ২০১০ সালের পর থেকেই থেমে গেল আমাদের বেতন বৃদ্ধি ও পদন্নতি।
আমরা একটু একটু করে আমাদের জীবন যাত্রার মান নিচে নামিয়ে আনতে শুরু করলাম। আমরা যারা দীর্ঘদিন যাবৎ সিটিসেলে কর্মরত আছি তারা প্রতিষ্ঠানটিকে ভালবেসে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম সুদিনের প্রত্যাশায়। আমরা সাধারণ কর্মচারীরা কঠোর পরিশ্রম করে যেতে লাগলাম আমাদের এই ভালবাসার প্রতিষ্ঠানটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে প্রতিযোগিতা মূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করা হলো না। উর্ধতন কর্মকর্তাদের তরফ থেকে শোনা যেতে লাগলো, প্রতিষ্ঠানটিকে পুনরায় বিক্রি করার চেষ্টা চলছে (উল্লেখ্য যে, এর আগে Singapur Telecom (Singtel) এর নিকট ৪৫% অংশিদারিত্ব বিক্রি করা হয়েছিল)। সিটিসেলের ক্রম অবনতির ফলে বাজারে এর সাধারন কর্মচারীদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা শুরু হতে লাগলো। আমরা অনেকেই নতুন চাকরির চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু সঙ্কুচিত চাকরির বাজার এবং আমাদের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনার কারণে খুব অল্প সংখ্যক কর্মচারী সুবিধাজনক নতুন চাকরি খুজে পেলেন। আমাদেরকে ক্রমশঃ হতাশায় পেয়ে বসতে থাকলো। আমরা বিচ্ছিন্ন ভাবে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সংগে যোগাযোগ করে আমাদের প্রতিষ্ঠানের গন্তব্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে থাকলাম এবং জানলাম কোম্পানী বিক্রি ও নতুন বিনিয়োগের প্রবল চেষ্টা চলছে। খুব শিঘ্রই হয়তো ভাল দিন আসবে। আমরা আশাবাদী হয়ে শুভ সময়ের অপেক্ষা করতে থাকলাম।
এখানে উল্লেখ্য যে বিগত দুই বৎসর যাবৎ আমাদের বেতন ভাতাদি অনিয়মিত হয়ে যেতে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় বর্তমানে আমাদের ৩ (তিন) মাসের বেতন বকেয়া হয়ে আছে। আমরা এখন অনিয়মিত ভাবে কখনও একমাসের বেতন আবার কখনও অর্ধেক মাসের বেতন পাচ্ছি। আমরা যারা ভাড়া বাড়ীতে থাকি, বাড়ী মালিকের সাথে তাদের সম্পর্ক ক্রমেই অবনতি হতে থাকলো। কেউ কেউ ভাড়া বাড়ী থেকে লজ্জাজনকভাবে বিতারিত হলো। অনেকে তার পরিবার গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হল। কারো সন্তানের স্কুল পরিবর্তন করতে হল। কারো সন্তানের স্কুলের ফি অধিকমাত্রায় বকেয়া হওয়ার কারণে সামাজিকভাবে লজ্জায় পরতে হল। পরিবার স্বজনদের সামান্য সখ পূরণ তো দূরের কথা নিত্য নৈমত্যিক সাধারণ চাহিদা পূরণ করতেও অনেকে ঋনে জর্জরিত হয়ে এক দূর্বিসহ ও ঝুকিপূর্ণ জীবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলো।
আমরা নিরুপায় হয়ে আবারও বিচ্ছিন্নভাবে উর্ধতন কর্মকর্তাদের আমাদের পরিস্থিতি জানালাম, আমাদের ভবিষ্যৎ কি হচ্ছে জানতে চাইলাম। উচ্চ পর্যায় (সিইও) থেকে সমসাময়িককালে এ পর্যন্ত দুইবার আমাদের ই-মেইল মারফত সুদিনের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় সময়ের একটা সম্ভাব্য রূপরেখাও তিনি দিয়েছিলেন। সে সময়ও পার হয়ে গেছে। অবস্থা দৃষ্টে এখন মনে হচ্ছে এতদিনের সব কিছুই ছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। আমরা এখন সামনে দেখছি শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার। আমরা দিশেহারা, আমাদের ভরসা দেবার আর কাউকে পাচ্ছিনা, আগামী দিন নিয়ে আমরা অত্যন্ত ভীত। দিশেহারা মানুষের গায়ে গা, পায়ে পা, হাতে হাত হয়ে আমরা অনেকটাই এক হয়ে গেছি। আমাদের দুঃখ এক, বিপদ এক, ভয়ও এক। সব ভয়কে জয় করে আমরা এক হয়েছি।
ঐক্যবদ্ধ মানুষের আকাঙ্ক্ষায় গত ১৯/০৬/২০১৬ ইং তারিখে প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন (PBTLEU) নামে একটি ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়েছে। যার প্রমাণপত্রসহ ই-মেইল মারফত উর্ধতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। উপরন্ত ইউনিয়নকে দুর্বল করার জন্য ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে বদলির আদেশ দেয়া হয়েছে। এমতবস্থায় কর্মচারীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা চাই না আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান (সিটিসেল) কোন ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাক, থেমে যাক সকল সম্ভাবনার দ্বার।
যখন আমাদের এরুপ করুন অবস্থা চলছে আর আমরা আশায় আশায় পার করছিলাম দূর্বিসহ জীবন, ঠিক সেই মুহুর্তে কাল ৩১/০৭/২০১৬ ইং এবং পরের দিন ০১/০৮/২০১৬ইং তারিখে প্রতিটি টিভি, অনলাইন পত্রিকা ও জাতীয় পত্রিকার অন্যতম খবর “বিটিআরসির পাওনা অনাদায়ে বন্দ হচ্ছে সিটিসেল”। হঠাৎ পাওয়া এই খবরে আমরা হতবাক! আমরা ভীত! আমরা দিশেহারা! কি হবে আমাদের প্রায় ৬০০ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ। কিভাবে আমরা পাবো আমাদের বকেয়া বেতন, PF, GF আর বিগত ৫ বছরের ক্ষতিপূরণ?
আমরা মনে করি সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগে আমাদের বিষয়গুলো অবশ্যই আপনাদের বিবেচনায় থাকবে। আপনাদের স্বদিচ্ছা ও উদ্যোগই পারে সিটিসেলের প্রাণ আবার ফিরিয়ে দিতে অথবা এতগুলো পরিবারের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষা দিতে। অনেকগুলি নিভু নিভু পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে দয়া করে আপনারা অতি দ্রুত হাত বাড়ান। আমরা আপনাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমরা আশাবাদী। বিনীত সিটিসেল-এর সাধারণ কর্মচারীদের পক্ষে-আশরাফুল করিম, সভাপতি, প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিঃ এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন (PBTLEU)।