‘জীবন বাজি রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত করেছি’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই হত্যা মামলার সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন আবদুল কাহার আকন্দ। এই হত্যা মামলার প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে পুলিশে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৭৩ সালে সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। বিভিন্ন জেলা পুলিশে কাজ করার পর ১৯৮৩ সাল থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কাজ শুরু করেন তিনি। মাঝে দুই বছরের জন্য বাইরে পোস্টিং হলেও ফের সিআইডিতেই আসতে হয় কাহার আকন্দকে। তারপর থেকে অবসর পর্যন্ত সিআইডিতেই কাটিয়ে দেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি চূড়ান্ত অবসরে যান।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়ে আবদুল কাহার আকন্দের তিনি বলেন, ২০ বছর পর মামলাটা রুজু হয়েছে। এই দীর্ঘসময়ে মামলার সাক্ষী, আলামত বা অন্যান্য প্রমাণাদি- অনেক কিছুই নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে। তাছাড়া এই মামলায় যে ডকুমেন্ট আমার পাওয়ার কথা তার অনেক কিছুই এদিক-সেদিক হয়েছে। সেগুলো আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি সংগ্রহ করার।

‘সাক্ষী যারা ছিলেন, দেখা গেছে তাদের অনেকে আবার ভুলে গেছেন। এমনকি আমরা মনে করেছি যারা নিজ উদ্যোগে সাক্ষ্য দেবেন, তাদেরকেও অনেক সময় পাইনি। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাদের পেতে। কারণ তারা সাড়া দেননি সেভাবে। এরকম অনেক আছে, এখন তাদের আর নাম বলবো না। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।’

স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম নায়ক ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যা মামলার তদন্ত নিঃসন্দেহে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার জন্য একদিকে যেমন গৌরবের, সেই সঙ্গে অনেক বেশি জটিলও।

এ প্রসঙ্গে কাহার আকন্দ  বলেন, একজন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা হয়েছে, যিনি এই দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এরকম একজন লোককে শুধু একা হত্যা করা হয়নি। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যকেও হত্যা করা হয়েছে। এত বড় একটা মামলা, এই মামলার তদন্ত করা অনেক কঠিন দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমাকে বেশ সচেতন থাকতে হয়েছে। নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু তদন্ত করতে হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীজুড়ে এর ব্যাপ্তি। তাই এটি কোনো স্বাভাবিক বা ছোট মামলা নয়।

তিনি বলেন, এই মামলার আসামি তৎকালীন সেনাবাহিনীর লোকজন। কাজেই তাদের যে কাজ বা পরিধি সেটা অনেক লম্বা। জীবন বাজি রেখে এই মামলার তদন্ত করেছি। অনেকেই এই মামলার তদন্ত করতে চাননি। আমি সেই দায়িত্বটা নিয়েছি এবং তদন্তটা করেছি।

মামলা তদন্তের বিষয়ে কাহার আকন্দ বলেন, এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আমাকে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিঠি দিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তদন্তের শেষে আমাকে চাকরি থেকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠিয়ে দেয়।

তিনি বলেন, আমাদের তদন্তের একটা পদ্ধতি আছে। স্বাভাবিক নিয়মে আমরা যেটা করি সেই পদ্ধতিগুলো আমরা কাজে লাগিয়েছি। এছাড়া হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করার জন্য আর্মির রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করেছি। মেজর ফারুক এবং মেজর রশিদ গ্রানাডা টেলিভিশনে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকার আমরা সংগ্রহ করেছি লন্ডন থেকে। এরকম অনেক জিনিসপত্র যা প্রয়োজন হয়েছে আমরা সেগুলো উদ্ধার করেছি এবং এই মামলার সাক্ষী ও আলামত হিসেবে ব্যবহার করেছি। এটি করতে আরও সময়ের প্রয়োজন ছিল। তারপরও আমরা ১০০ দিনের মধ্যে মামলার তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছি।

কাহার বলেন, মামলা যখন হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল, তখন অনেক বিচারক বিব্রতবোধ করেছেন। কিন্তু আমি বিব্রতবোধ করিনি। আমি মামলাটি তদন্ত করেছি এবং সমস্ত ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছি। ১৫ জন আসামির ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। পরে ১২ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল থাকে। এদের ৬ জনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়েছে আর কিছু পলাতক রয়েছেন।

‘ইতিহাসের কলঙ্কিত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনিদের বিচারের মুখোমুখি করতে পেরেছি, এটাই আমার জীবনের স্বার্থকতা বলে মনে করি।’ যোগ করেন কাহার আকন্দ।

এর আগে গত ১২ আগস্ট শিল্পকলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আমার একজন সাক্ষী ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। তিনি মামলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষী ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কাগমারী সম্মেলনের পর দলের মধ্যে নেতৃত্বের অবস্থান নিয়ে খন্দকার মোশতাক ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব ছিল। ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান দলে সুদৃঢ় হতে থাকে। অন্যদিকে খন্দকার মোশতাকের অবস্থান একই অবস্থায় থাকে। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি মোশতাক ঈর্ষাকাতর ছিলেন।’

কাহার আকন্দ বলেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী নামের একজন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। খন্দকার মোশতাককে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়, আর তাকে করা হয় প্রতিমন্ত্রী। দেওয়ান ফরিদ গাজী বলেছেন, ‘খন্দকার মোশতাক ১৯৭৪ সালে বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রকাশ করার জন্য ফরিদ গাজী খন্দকার মোশতাকের কাছে গেলেন। মোশতাক তাকে নির্দেশ দিলেন যে তুমি এটা প্রকাশ করো।

‘‘নথিটা কিসের ছিল সেটা আমার (আকন্দ) কাছে বলা হয়নি। তখন ফরিদ গাজী বললেন, এটা বঙ্গবন্ধুকে বলতে হবে। উনি এই দায়িত্ব নিতে চাচ্ছেন না, আবার খন্দকার মোশতাকও দায়িত্ব নিচ্ছেন না। তখন খন্দকার মোশতাক রাগান্বিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেন, `He does not know that he is walking on the grave.’বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনার কিছুদিন আগেই এই কথা বলেন। সেসময় ফরিদ গাজী বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে বললেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, ‘রাখ রাখ’।’’

২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি এক বছরের চুক্তিতে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি নিয়োগ পান কাহার আকন্দ। এর আগে তিনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে চুক্তিতে নিয়োজিত ছিলেন।

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার মামলারও তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার অধিকতর তদন্তের দায়িত্বেও ছিলেন কাহার আকন্দ। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের কাছে ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত যুগ্ম-সচিব নিকুঞ্জ বিহারী নাথ হত্যা মামলা, মতিঝিলে ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত সার্জেন্ট আহাদ মামলারও তদন্তের দায়িত্ব পালন করেছেন এ কর্মকর্তা।

বিগত চার দলীয় জোট সরকার কাহার আকন্দকে চাকরিচ্যুত করে। আদালতের মাধ্যমে ৭ বছর পর ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি তিনি চাকরি ফিরে পান।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.