গত ১১ আগস্ট রাতে হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন প্রবাসী মোহাম্মদ মনির হোসেন। সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইনসের (সাউদিয়া) এসভি৮০৫ ফ্লাইটে সৌদি আরব যাবেন তিনি। বিমানবন্দরে টার্মিনালে প্রবেশ করে সাউদিয়ার কাউন্টারের সামনে আসেন। সেখানে সাদা শার্ট পরা ও গলায় আইডি কার্ড ঝুলানো এক ব্যক্তি তাকে কাছে ডাকেন। তিনি মনির হোসেনের পাসপোর্ট দেখতে চান, পাসপোর্টের পাশাপাশি তার ভিসা, ভ্যাকসিন সার্টিফিকেটেও দেখেন।
তারপর মনির হোসেনকে বলেন, ‘আপনি সৌদি যেতে পারবেন না, কারণ আপনার করোনার টিকার বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়নি এবং আরও সমস্যা রয়েছে পাসপোর্টে। এসব কারণে আপনাকে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে পাঠালে ১৪ দিনের জেল দেওয়া হবে। সৌদি পাঠাবে না এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ।’
এসব কথা শুনে ভয় পেয়ে যান সৌদি আরব প্রবাসী মোহাম্মদ মনির হোসেন। আতঙ্কগ্রস্ত মনির ওই ব্যক্তির কাছে জানতে চান কীভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে। ওই ব্যক্তি ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে সব সমস্যা সমাধান করার কথা জানায় মনিরকে। কিন্তু মনিরের কাছে তখন এতো টাকা নেই, ঘাবড়ে যান তিনি। বাইরে অপেক্ষা করা তার স্বজনদের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন মনির।
সেই ব্যক্তি রাজি হলে বাইরে থেকে টাকা নিয়ে আসেন তিনি। পরে সেই ব্যক্তি মনিরকে সরাসরি হাতে টাকা না দিয়ে পাসপোর্টের মধ্যে ভাঁজ করে দিতে বলেন। টাকা হাতে পাওয়ার পর মনিরের সব কিছু ঠিক হয়ে যায়, তাকে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘আপনার সব ঠিক আছে, আর কোনও সমস্যা হবে না।’ এরপর মনির সৌদি আরবে পৌঁছান।
নেম প্লেট ঢাকা থাকায় ওই ব্যক্তির নাম দেখতে পারেননি প্রবাসী মোহাম্মদ মনির হোসেন। কিন্তু তিনি সৌদি পৌঁছানোর পর বুঝতে পারেন, তার সঙ্গে প্রতারণা হয়েছে। মনির হোসেন বলেন, ‘আমি জানতাম সৌদি আরবে ২ ডোজ টিকা হলেই যথেষ্ট। কিন্তু আমাকে যখন বুস্টার ডোজের কথা বললো, আমি তো হতবাক হয়ে গেলাম। আর বিমানবন্দরের লোক যেহেতু বলছে, আমি অবিশ্বাসও করতে পারছিলাম না। আর আমি যদি ফ্লাইট মিস করি আমার টিকিটের টাকা নষ্ট হবে, সৌদি আরবে ছুটির মেয়াদও প্রায় শেষ। একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আমি তাকে টাকা দিতে রাজি হই।’
মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, ‘সৌদি আসার পর আমি নিশ্চিত হলাম, সৌদিতে আসতে বুস্টারের প্রয়োজন নেই। তার মানে আমাকে ভয় দেখিয়ে প্রতারণা করে টাকা নিয়েছে। শুনেছি বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা কঠোর হয়েছে, তার মধ্যেও এসব প্রতারণা কি করে হয়! আমি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও আর্মড পুলিশের কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’
মোহাম্মদ মনির হোসেনের লিখিত অভিযোগ পেয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সদস্য (পরিচালনা ও পরিকল্পনা) এয়ার কমোডোর সাদিকুর রহমান চৌধুরী যাত্রীর অভিযোগের বিষয়ে খতিয়ে দেখতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তদন্তের নির্দেশনা দেন। বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ মামুনের নেতৃত্বে একটি দল যাত্রীর অভিযোগ পর্যালোচনা করে সেদিনের সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে।
জানা যায়, সেই ব্যক্তির নাম মান্নান হোসেন। সে সাউদিয়ার ট্রাফিক হেলপার হিসেবে কাজ করছে। জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের কাছে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে মান্নান। নানা অজুহাতে সৌদিগামী যাত্রীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা নিতো সে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সে এতটাই চতুর যে, সিসি ক্যামেরা চোখ ফাঁকি দিতে অনৈতিকভাবে নেওয়া এই অর্থ কখনোই সরাসরি নিতো না। যাত্রীকে টাকা ভাঁজ করে পাসপোর্টের ভেতরে দিতে বলতো। প্রতারণা করতে নানা কৌশলে অবলম্বন করেও বেশি দিন আড়ালে থাকতে পারেনি।
অবশেষে সৌদি আরব প্রবাসী মনির হোসেনের অভিযোগে চাকরি খুইয়েছে মান্নান হোসেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, সাউদিয়ার সেই কর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে, অনৈতিকভাবে টাকা নিলে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
যাত্রীদের কাছে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এমন কোনও পরিস্থিতিতে পড়লে তারা যেন আমাদের কাছে অভিযোগ দেন।’