দৈনিক জনকণ্ঠ: বিমানের সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের শতকরা ৮০ ভাগই অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ ও লুটেরা। বাকি ২০ ভাগ নীতিবান ও পেশাদার। একইভাবে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ দুর্নীতিবাজ ও ফাঁকিবাজ। বাকি ৮০ ভাগ ভাল। তারা শুধু কাজই করে। দুর্নীতির সুযোগ পায় না বা করে না। গত চল্লিশ বছর ধরে বলা হচ্ছে- সিবিএ আর ইউনিয়ন কাজ করে না, তারা শুধু ওভারটাইম নেয়। এটা গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। বিমানের একজন জিএম বা পরিচালক এক বছরে যে দুর্নীতি করে- এক হাজার কর্মচারী সারা বছরেও তা করে না। আমি গত এক বছরে বিমানের কোন সিবিএ বা ইউনিয়নের সঙ্গে কোন মতবিরোধে পড়িনি। তারা বিমানের সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে বিমানের পরিচালনা পর্ষদ ও সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট।
বিমানের বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক জন কেভিন স্টিল এভাবেই তাঁর ব্যক্তিগত মূল্যায়ন করেছেন। তিনি বিমানকে বিপুল সম্ভাবনার একটি এয়ারলাইন্স হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এ মুহূর্তে বিমানকে রক্ষা করতে হলে দুটো কাজ করতেই হবে। একটি হচ্ছে- মন্ত্রণালয়, পরিচালনা পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের মধ্যে সমন্বিত ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা আর অপরটি হচ্ছে বিমানের শেয়ার ছাড়া। এ দুটো ছাড়া বিমানকে কিছুতেই লাভের মুখে নেয়া যাবে না।
গত বুধবার বলাকার নিজ কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি বিগত এক বছরে বিমানে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা প্রকাশ করেন দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে। এক বছরে তিনি কাজ করতে গিয়ে কিভাবে কোন্ কোন্ মহলের দ্বারা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছেন, রাঘব বোয়ালদের দুর্নীতিতে বাধা দিতে গিয়ে তিনি কিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, একজন জিএম বছরের পর বছর ধরে কিভাবে শত শত কোটি টাকার কেনাকাটায় প্রকাশ্যে দুর্নীতি করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন, সে কাহিনীও তুলে ধরেছেন যথেষ্ট প্রমাণাদিসহ। জনকণ্ঠের কাছে দিয়েছেন বেশ কয়েকটি ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত।
কেভিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে বিমানকে সন্তানের মতো ভালবেসে তদারকি করেন, পৃষ্ঠপোষকতা করেন, তার পরও সে প্রতিষ্ঠান কেন ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, কেন লাভের মুখ দেখছে না- সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। জাতীয় এয়ারলাইন্সের প্রতি কোন রাষ্ট্রনায়কের এত দরদ, এত আগ্রহ ও সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়ার নজির নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য বিমান ম্যানেজমেন্টের। তারা এর মূল্য দিতে পারছে না।
কেন বিমান ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না- জানতে চাইলে থমকে যান তিনি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইতোস্তত করেন এ সম্পর্কে কিছু বলতে। তখন তাঁকে বলা হয়- সমস্যা চেপে রেখেই তো বিমানের সর্বনাশ ঘটানো হচ্ছে। আপনিও কি পূর্বসূরিদের মতো সব ধামাচাপা দিয়ে বিদায় নেবেন? আসল সমস্যা কোথায় দেশ জাতি সরকারকে তা না জানালে সমাধান আসবে কী করে।
এরপর তিনি বেশ বিব্রতকর ভঙ্গিতেই বলতে থাকেন, কোত্থেকে শুরু করব? বিমানের ঘাটে ঘাটে সমস্যা। সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের প্রতিটি শাখাতেই রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট আর অপচয়। এটা যে শুধু দেশে তা নয়; বিদেশেও। বলাকা, মতিঝিল, হ্যাঙ্গার, বিএফসিসি, এয়ারপোর্ট, কাস্টমার সার্ভিস, ফরেন পারচেজ ও মোটর শাখার দুর্নীতি মাঝে-মধ্যে মিডিয়ায় প্রকাশ হলেও বিদেশী স্টেশনগুলোর সাগর চুরির মতো দুর্নীতি বরাবরই থেকে গেছে অজানা অদেখা। দুর্নীতি মেনে নিয়েও বিমানকে লাভের মুখ দেখানো সম্ভব। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট সেদিকে নজর দিচ্ছে না। যেমন এখানকার সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট তথা এমডি, ডিরেক্টর ও জিএম পদমর্যাদার কর্তাদের লক্ষ্য বা টার্গেট নেই; নেই কোন দায়বদ্ধতা। বিমান একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এ ধারণাটাই নেই তাদের।
ওরা শুধু চাকরি করছে আর দশটা সরকারী পদের মতো। ৯টায় আসে, ৫টায় যায়। তারপর কী হলো না হলো, সে নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা থাকে না। মাস গেলে বেতন হলেই খুশি। বছর শেষে বিমান কেন লোকসান দিচ্ছে- এ নিয়ে একজন গাড়ির ড্রাইভার চিন্তা করলেও সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের বেশিরভাগই এ নিয়ে ভাবে না। অথচ বোর্ড মিটিংয়ে সব দায় চাপানো হয় কর্মচারী, সিবিএ ও ইউনিয়নের ওপর। কথায় কথায় দোষ দেয়া হয়, কাজ না করে শুধু ওভারটাইম নেয়া হয়। এটাই নাকি মূল কারণ। কিন্তু আমি স্পষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অঙ্ক করে দেখিয়ে দিতে চাই- এ সব কথা আদৌ ঠিক নয়।
যেমন এক বছরে বিমানের বেতন-ভাতা, জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ, কেনাকাটাসহ সবকিছু মিলিয়ে খরচ হয় পাঁচ শ’ মিলিয়ন ডলারের মতো। এর মধ্যে সবার বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হয় বড়জোর শতকরা ২০ ভাগ। যার মধ্যে সর্বোচ্চ তিন লাখ ডলার ব্যয় হয় ওভারটাইম বাবদ। এ পাঁচ শ’ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে বেশিরভাগই (২৪০ মিলিয়ন ডলার) ব্যয় হয় জ্বালানি খাতে। বাকি টাকা যায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, জিএসই, রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশল, লিজ ও অন্যান্য খাতে। যেগুলোর কেনাকাটায় সরাসরি বিমানের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট এমনকি কোন কোন বোর্ড মেম্বার পর্যন্ত জড়িত।
এ সময় দুই-একটি উদাহরণ জানতে চাইলে কেভিন কিছু তথ্য-প্রমাণাদিসহ তুলে ধরেন দুর্নীতির ভয়াবহ কাহিনী। বছরের পর বছর ধরে জিএসই বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা একই কায়দায় একই কোম্পানির কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের কেনাকাটা করছে। ৩০ হাজার ইউরো দিয়ে কেনা পুশব্যাক টু ট্রাক্টরের স্পেয়ার পার্টস কেনা হয়েছে ৮০ হাজার ইউরো দিয়ে। দুনিয়ার কোন এয়ারলাইন্সে দুর্নীতির এমন নজির আর কোথায় আছে বলে আমার জানা নেই। ওই কর্মকর্তার নিজস্ব আত্মীয়ের একটি কোম্পানি মাদারল্যান্ডকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্যই যেন তাঁর চাকরি। এ ছাড়া লাগেজ কন্টেনার কেনার জন্য ওই কর্মকর্তা সুনির্দিষ্ট একটি কোম্পানির নাম ও ধরন উল্লেখ করে দরপত্র দিয়েছে, যাতে অন্যকোন কোম্পানি অংশ নিতে না পারে।
এ দুর্নীতির প্রতিবাদ বা ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও বিমানের পরিচালনা পর্ষদের প্রভাবশালীরাও চুপসে গেছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় পরিচালনা পর্ষদের একজন প্রভাবশালী সদস্য, যিনি পেশায় অডিটর, তিনি বিমানের জিডিএস কোম্পানি ট্রাভেলপোর্টারের সঙ্গে জড়িত। শুধু এ কারণেই বিমানকে বছরে ৩০ মিলিয়ন ডলার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এ কাজটা বিমানের পার্টনার এবাকাসের মাধ্যমে করতে পারলে এ খাতে অনেক অপচয় ঠেকানো যেত। বিমানকে রক্ষা জন্য দুটো আশু করণীয় সম্পর্কে কেভিন বলেন, বর্তমানে যে ধরনের পরিচালনা পর্ষদ রয়েছে তাতে কোন দিনই সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট নিজস্ব লক্ষ্য ও কৌশল নিয়ে কাজ করতে পারবে না।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় ম্যানেজমেন্ট যে কোন কাজ করতে হলে পর্ষদের অনুমতি লাগে। কিন্তু এমডি পক্ষে সেটার ব্যতয় ঘটানো দূরের কথা, তাকে অপদস্থ হয়ে বিদায় নিতে হয়। লক্ষ্য করুন- বিগত পাঁচ বছরে কতজন এমডিকে বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু বোর্ডের প্রভাবশালী তো জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছেন। তাঁকে কারও কাছে কোন জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। ঠিকই লোকসানের দায়ভার নিতে হচ্ছে ম্যানেজমেন্টকে। আবার মন্ত্রীর কোন ক্ষমতাই নেই কিন্তু তাঁকে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে জাতির কাছে ঠিকই জবাবদিহি করতে হয়। দুনিয়ার কোন এয়ারলাইন্সে এমন অস্বাভাবিকতা নেই।
শেয়ার ছাড়ার যৌক্তিকতা সম্পর্কে কেভিন বলেন, বিমানে এখন যাঁরা সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে আছেন, তাঁদের কোন জবাবদিহিতা নেই। তাঁদের কোন টার্গেট বা দায়বদ্ধতা নেই। কী করতে হবে এটাই তাঁরা জানেন না। যেমন বিমানে বর্তমানে ৬টি বোয়িং ৭৭৭, দুটো এয়ারবাস, দুটো ৭৩৭ উড়োজাহাজ রয়েছে। তার বিপরীতে রয়েছে ১৯টি রুট আর হাজার চারেক জনবল। এ অবস্থায় লোকসান এড়াতে হলে প্রতিটি উড়োজাহাজের ন্যূনতম লোড ফ্যাক্টর কত হওয়া দরকার- এটাই জানে না বিমান ম্যানেজমেন্ট। পেশাদার লোক প্রয়োজনের তুলনায় খুব নেই। যাঁরা আছেন তাঁদেরও ঠিকমতো কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। দলাদলি, গ্রুপিং আর হীন রাজনীতির মতো তৎপরতা তো লেগেই আছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে বিমানকে অবশ্যই শেয়ার ছাড়তে হবে। আইপিও করা হলে শেয়ারহোল্ডারদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তখন যাচ্ছেতাই করা যাবে না।
নিউইয়র্ক ফ্লাইটের ভাগ্য সম্পর্কে কেভিন তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, মনে হয় এটা নিয়েও রাজনীতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মনেপ্রাণে চান নিউইয়র্ক ফ্লাইটটা পুনরায় চালু হোক। কিন্তু এটা করতে গেলে হয় বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনকে ক্যাটাগরি ওয়ান করতে হবে- যেটা আপাতত হওয়ার কোন লক্ষণ বা সম্ভাবনা নেই। আরেকটা বিকল্প হচ্ছে- ক্যাটাগরি ওয়ান কোন দেশ থেকে ওয়েট লিজে উড়োজাহাজ এনে চালু করা। আমি এই উদ্যোগটা নিয়েছিলাম। অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলাম কিন্তু তাতেও বোর্ড সম্মতি দেয়নি। যে কারণে এটা আর হচ্ছে না। লোকসানী রুটকে কিভাবে লাভজনক করা যায়, জানতে চাইলে কেভিন তাঁর উদ্যোগে চালু করা ফ্রাঙ্কফ্রুট রুট সম্পর্কে বলেন, বর্তমানে এ রুটে খুব একটা যাত্রী হচ্ছে না।
আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, জার্মানি থেকে যাত্রীদের ঢাকায় এনে বিমানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আঞ্চলিক গন্তব্যে যেমন- নেপাল, থাইল্যান্ড, চীন, মিয়ানমার, কলকাতা ও সিকিম নেয়া যেতে পারে তাহলেই যাত্রী বাড়বে। এটাকে লাভজনক করা যাবে। এ ছাড়া ফ্লাইট সময়ানুবর্তিতা, যাত্রীদের নিরাপত্তা, সেবা ও আতিথেয়তা নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই বিমানকে লাভজনক করা যাবে। ম্যানেজমেন্টকে নির্বিঘ্নে এগুলো করতে দিতে হবে। নইলে নতুন সিইও এলে তাঁকেও আমার মতো রণে-ভঙ্গে দিতে হবে।