ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শিগগিরই বাংলাদেশে আসতে চান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষায় রয়েছেন।
ভারতের নতুন পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর গতকাল সোমবার শেখ হাসিনার হাতে নরেন্দ্র মোদির একটি চিঠি তুলে দিয়েছেন। ওই চিঠিতে মোদি ঢাকা সফরের জন্য নিজের আগ্রহের কথা শেখ হাসিনাকে জানান।
সন্ধ্যায় শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতীয় সংসদ ভবনে তাঁর দপ্তরে জয়শঙ্করের সৌজন্য সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী গণমাধ্যমকর্মীদের এসব তথ্য জানান।
প্রথম পর্যায়ের সার্ক যাত্রার অংশ হিসেবে সকালে ভুটান থেকে ঢাকায় আসেন জয়শঙ্কর। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা জোরদারের জন্য তাঁকে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন নরেন্দ্র মোদি।
জয়শঙ্কর দিনের শুরুতে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ: প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী জানান, প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, তিনি আগ্রহের সঙ্গে ঢাকা সফরের জন্য অপেক্ষা করছেন। নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে জয়শঙ্কর আবারও শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব প্রধানমন্ত্রীকে জানান, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে ঢাকার সঙ্গে শিগগিরই বাণিজ্য প্রটোকল ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি সই করতে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। প্রেস সচিব জানান, ঋণচুক্তির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্প ভালোভাবে এগোচ্ছে বলে জয়শঙ্কর ভারতের সন্তোষের কথা জানান।
বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ ও ভারতের সহযোগিতার বিষয়েও বৈঠকে কথা হয়। ত্রিপুরার পালাটানা থেকে আরও বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে আগ্রহ দেখান শেখ হাসিনা। জবাবে জয়শঙ্কর বলেন, অবশ্যই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আসবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুই দেশের বেসরকারি খাতকেও কাজে লাগানোর কথা বলেন তিনি। বৈঠকে ভুটান থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনার বিষয়েও আলোচনা হয় বলে জানান শামীম চৌধুরী।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী এবং বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে বৈঠক: জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের জানান, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির ব্যাপারে ভারতের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বিষয়টি সুরাহার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে ভারত। সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁদের মধ্যে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। বিকেলে বৈঠকের বিষয়ে ব্রিফ করেন শহীদুল হক।
শহীদুল হক বলেন, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে। দুই দেশের ‘প্রগাঢ় বন্ধুত্ব’ প্রতিষ্ঠা ছিল ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের শুভেচ্ছা সফরের মূল বার্তা। তিনি মনে করেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা দ্রুত সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন।
তবে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত দুই সমস্যা—স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও তিস্তা চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি হয়েছে কি না, সেটি শহীদুল হক গণমাধ্যমকর্মীদের জানাতে পারেননি। তিনি বলেন, সব বিষয় নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা হয়েছে। তবে সম্পর্কের ব্যাপকতার কারণে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। আর এ ধরনের শুভেচ্ছা সফরে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা হয় না। সীমান্ত হত্যার প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দুই পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈঠকে অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার উল্লেখ করার চেয়ে দ্বিপক্ষীয়, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতার কোন বিষয়গুলো এগিয়ে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব ছিল জয়শঙ্করের।
জয়শঙ্করের সঙ্গে বাংলাদেশের একাত্মতা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। একাত্তরে ১৬ বছরের তরুণ জয়শঙ্কর ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ জয়প্রকাশ নারায়ণের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর বাবা সাবেক আমলা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক কে সুব্রামানিয়ামও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে প্রথম ঢাকা সফরে একাত্তর নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন জয়শঙ্কর।
সীমান্ত পরিস্থিতি বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্প্রতি রাবার বুলেট ব্যবহার করার ফলে সীমান্ত হত্যা কমেছে। এখন উদ্বেগজনক হারে গরু ও মাদকের চোরাচালান বাড়ছে। কাজেই সীমান্তের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি।
বাংলাদেশ এ সময় সীমান্ত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সীমান্তে সামগ্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্তে অবৈধ তৎপরতা কমাতে ১৬টি শুল্কবন্দর উন্নয়নে যৌথ উদ্যোগের প্রসঙ্গ তোলে। এ ধরনের উদ্যোগ সীমান্তে পণ্য ও মানুষের অবৈধ কর্মকাণ্ড কমাতে সহায়ক হবে। লোকজনের বৈধ চলাচল বাড়বে।
বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়, চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে আগ্রহী বাংলাদেশের অসুস্থ লোকজনের প্রয়োজনের তুলনায় ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে জনবল ও রসদের অভাব রয়েছে। বিষয়টি সুরাহার কথা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া আগরতলায় বাংলাদেশের ভিসা অফিসের আধুনিকায়নে ভারত সম্মতি দিয়েছে।
মোটরযান চুক্তি ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি দ্রুত সই করতে ভারতের আগ্রহের কথা জানান জয়শঙ্কর। তিনি উল্লেখ করেন, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালকে নিয়ে ভারত মোটরযান চুক্তি সই করতে আগ্রহী।
বিনিয়োগের পথ সুগম করতে নৌ প্রটোকল চুক্তিটি ভারত দীর্ঘ মেয়াদে নবায়নের কথা তুলেছে। দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তিটি নবায়ন করা হলে তাতে বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যাবে।
আজ মঙ্গলবার সকালে জয়শঙ্করের পাকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা।
আরও খবর
