দেশে এক বছরে বিমানযাত্রীরা স্বর্ণ এনেছেন ৪৬ লাখ ভরি

এক বছরে দেশে বিমানযাত্রীদের মাধ্যমে বৈধভাবে ৪৬ লাখ ভরির সমপরিমাণ ৫৪ টন সোনার বার এসেছে। এর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালে ঢাকার শাহজালাল এবং চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এই সোনা আসে। আগের বছরের তুলনায় তা ৫৩ শতাংশ বেশি।

একই সময়ে শুধু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবৈধ সোনা জব্দ করা হয় প্রায় ৫০০ কেজি বা ৪২ হাজার ৯১৫ ভরি। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে জব্দ হওয়া অবৈধ সোনার হিসাব পাওয়া যায়নি।

বৈধভাবে সোনা আনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব আয় বাড়লেও প্রবাস আয় বা রেমিট্যান্সে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে অনেক প্রবাসীর সোনাক্ষেত্রে এটা সরাসরি ডলার নিয়ে আসাকে নিরুৎসাহ করছে।

কারণ স্বর্ণ বিক্রি করে তাঁরা কিছু লাভ পাচ্ছেন।

জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ২০২২ সালের করা এক প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, বৈধভাবে সোনার বার আসা বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স কমছে। বৈদেশিক মুদ্রায় রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে সোনা আনলে প্রবাসীরা ব্যক্তিগতভাবে বেশি লাভবান হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে তারা উড়োজাহাজের ব্যাগেজ রুলস সংশোধন এবং সোনার বার আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।

ব্যাংক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সোনার বার আনার বদলে বিদেশফেরত ব্যক্তিরা বৈধ পথে ওই টাকা রেমিট্যান্স পাঠালে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে যোগ হতো। এই মুদ্রা ডলারের বিদ্যমান সংকট কাটাতে কিছুটা সহায়ক হতো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিট্যান্স কম আসার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে দেশে বৈধ-অবৈধ পথে আসা সোনায়ও রেমিট্যান্সের অর্থ লগ্নি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২০২০ সালে প্রথম দুটি সোনার বার শুল্ক পরিশোধ করে বৈধভাবে আনার সুযোগ দেয়।

অভিযোগ উঠেছে, বাণিজ্যিক আমদানির চেয়ে ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে সোনা আনার খরচ কম হওয়ায় ব্যবসায়ীদের অনেকে এই পথে সোনা আনছেন। আইনত বৈধ বলে তা আটকানোর সুযোগ নেই। কিন্তু এতে সরকার রাজস্ব কম পাচ্ছে। তাই ব্যাগেজ রুলস সংশোধনের দাবি করছেন প্রকৃত ব্যবসায়ীরা।

সম্প্রতি দেশে সোনার প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ ও ব্যাগেজ রুলসের অপব্যবহার নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনার প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)।

বাজুসের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘ব্যাগেজ রুলসের আওতায় পরিবারের মানুষের জন্য ১০০ গ্রাম সোনা আনা হয়, সেটা ঠিক আছে। বিদেশ থেকে সোনা কেনার সময় যে ক্রয় রসিদ দেওয়া হয়, সোনা পাচারকারীরা বিভিন্ন যাত্রীর হাতে সেই ক্রয় রসিদ ও সোনা দিয়ে দেয়। পরে বিমানবন্দরে তাদের লোকজন রসিদসহ সোনা নিয়ে যাত্রীদের কিছু টাকা দিয়ে দেয়। আবার একই রকম ক্রয় রসিদ দেশেও তো তৈরি করতে পারে অসাধু লোকজন। তাই আমরা ব্যাগেজ রুলস বন্ধ করার দাবি জানাই। ’

আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশে সোনার চাহিদা আছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মেট্রিক টন। বাকি সোনা পাচার করা হচ্ছে। একে কেন্দ্র করে মানি লন্ডারিং হচ্ছে। রেমিট্যান্স কমছে। তবে যাঁরা ১০০ গ্রাম সোনা আনেন, সেগুলোও যাতে অবশ্যই যাচাই-বাছাই করা হয়।

২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাস আয় বেড়েছিল ১১ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বৃদ্ধির হার ৩৬ শতাংশ। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে করোনার ধাক্কায় প্রবাস আয় কমে যায় ১৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) প্রবাস আয় এসেছে এক হাজার ৬০৩ কোটি ডলারের মতো, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ বেশি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আহসানুল আলম পারভেজ মনে করেন, রেমিট্যান্স বাড়া-কমার সঙ্গে বৈধভাবে সোনার বার আনার পরোক্ষ সম্পর্ক আছে। অনেকে সোনার বার আনছেন ব্যবসার জন্য, অনেকেই আনছেন প্রয়োজনে। কেউ আনছেন ডলারের চেয়ে সোনার বার রাখা নিরাপদ বলে। তিনি আরও বলেন, তবে সোনার বারে শুল্ক যদি বেশি হতো তাহলে অনেক প্রবাসী হয়তো বৈধভাবে রেমিট্যান্স হিসেবে সেই টাকা দেশে পাঠাতেন। কিন্তু সেই হার কত, তা এখনো পরিসংখ্যান দিয়ে বলা যাবে না।

বাংলাদেশে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা আনার হিসাব পাওয়া গেছে। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে ২০২১ সালের ছয় মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিলেট দিয়ে খুব বেশি সোনা আসে না। এর মূল কারণ দুবাই-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট নেই। আর বাংলাদেশে যত সোনার বার আসে তার ৯৫ শতাংশই আসে দুবাই, আবুধাবি, শারজা থেকে আসা ফ্লাইটে।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে প্রতি মাসে পৌনে দুই টন সোনা আসে

চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে পৌনে দুই টন সোনার বার ঢুকছে। সোনার বার হিসাব করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার পিসের বেশি। বিমানযাত্রীরা ঘোষণা দিয়ে শুল্ক পরিশোধ করেই এগুলো আনছেন। বিপরীতে প্রতি মাসে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে ৩৯ কোটি টাকার মতো।

বৈধভাবে দুটি সোনার বার আনা যায়

শুল্ক পরিশোধ করে একজন যাত্রীকে দুটি সোনার বার আনার বৈধতা দেওয়ার পর থেকেই দেশে সোনা আনার পরিমাণ বেড়েছে, যা প্রতি মাসেই নতুন রেকর্ড গড়ছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সোনার বার আনার রেকর্ড হয়, যার পরিমাণ প্রতি মাসে গড়ে দেড় হাজার কেজি। চলতি বছরে সোনার বার আনার পরিমাণ গত বছরের চেয়েও বেড়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের মুখপাত্র ও উপকমিশনার বদরুজ্জামান মুন্সি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বৈধভাবে সোনার বার আনায় বেশ ভালো রাজস্ব আসছে এই খাত থেকে। কিন্তু এই সোনার বার কোথায় যাচ্ছে, সেটি আমাদের এখতিয়ারে নেই। ’

চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে যে স্বর্ণ আসে, সেগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস। তাদের হিসাবে, গত তিন মাসে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে ৪৫ হাজার ২৭৭টি সোনার বার ঘোষণা দিয়ে এসেছে। এর পরিমাণ পাঁচ হাজার ২৯৭ কেজি।

দুই বিমানবন্দরের তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে সাড়ে পাঁচ টন, ২০২১ সালে ৩৫ টন এবং ২০২২ সালে প্রায় ৫৪ টন সোনা এসেছে।

২০২০ সালে অবশ্য করোনার কারণে উড়োজাহাজে যাত্রী পরিবহন কম হয়েছিল। ওই বছর ২৩ হাজার ৬৭৪ জন, ২০২১ সালে এক লাখ ৫১ হাজার ৯১৭ জন এবং ২০২২ সালে প্রায় দুই লাখ ৩২ হাজার জন যাত্রী সোনা এনেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে এখন সোনা মজুদ আছে ১৪ টন। দেখা যাচ্ছে, এর চেয়ে অনেক বেশি সোনা চলে আসছে যাত্রীদের হাত ধরে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বৈধ পথে দুইভাবে সোনা আমদানি করা যায়। ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে স্বর্ণ আমদানি করতে পারে।

আবার ব্যাগেজ রুলসের আওতায় যাত্রীরা স্বর্ণ ও স্বর্ণের বার শুল্ক পরিশোধ করে আনতে পারবেন। ব্যাগেজ আইনে বলা আছে, একজন যাত্রী সর্বোচ্চ দুটি সোনার বার (২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি) ঘোষণা দিয়ে আনতে পারবেন। প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা হিসাবে মোট ৪০ হাজার ১২৪ টাকা শুল্ক পরিশোধ করে একজন যাত্রী সোনা আনতে পারবেন। এর বাইরে ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার বিনা শুল্কে আনতে পারবেন, তবে সেটি ২২ ক্যারেটের হতে হবে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.