এভিয়েশন নিউজ : (৫ ফেব্রয়ারী ২০১৫) কোমল পানীয়র সঙ্গে ড্রাগ জাতীয় ওষুধ খাইয়ে বিমানের ‘না’ আদ্যক্ষরের এক কেবিন ক্রুকে অচেতন করে গণ যৌন নির্যাতন চলানো হয়। পাষবিক ও নির্মম এই বর্বর নির্যাতনের মুল হোতা বিমানের চীফ পার্সার রঞ্জুকে সাময়িক বহিস্কার করা হলেও অন্যতম হোতা সিনহার বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
বিমানের প্রশাসন বিভাগ সুত্রে জানাগেছে তারা কেবল রঞ্জুকে চাকরী থেকে সাময়িক বহিস্কার করে বিভাগীয় চার্জশীট প্রদানের জন্য নির্দেশনা সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছে। এরপরই চিফ পার্সার রঞ্জুকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়। কিন্তু সিনহার বিরুদ্ধে এখনো কোন আদেশ পায়নি তারা।
এই অবস্থায় তোলপাড় উঠেছে পুরো বিমান জুড়ে। বিমানের কেবিন ক্রুদের একটি সুত্রে জানাগেছে এই পাষবিক ও নির্মম নির্যাতনের ঘটনার অন্যতম হোতা সিনহার বিরুদ্ধে অবলিম্বে কোন ব্যবস্থা না নিলে তারা একযোগে পদত্যাগ করবেন। তারা অবিলম্বে সিনহাকেও চাকরীচ্যুতসহ বিভাগীয় চার্জশীট প্রদানের দাবি জানান। অন্যথা এধরনের লোম হর্যক নির্যাতনের ঘটনা আরো বাড়বে।
তদন্তকারী সংস্থা সুত্রে জানাগেছে, এই ঘটনার সঙ্গে বিমানের চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রঞ্জু ও স্টুয়ার্ড অপুক মুমের সিনহাসহ তাদের লন্ডস্থ দুই কোটিপতি ব্যবসায়ীও জড়িত ছিল। তারা সবাই মিলে ভিকটিম কেবিন ক্রুকে অচেতন করে ঘুমের ঘোরে গণ যৌন নির্যাতন চালিয়েছে। পরবর্তীতে প্রবাসী লন্ডস্থ ওই দুই বন্ধুই সংশ্লিষ্ট হোটেলের সিসি ক্যামেরার যাবতীয় ফুটেজ গায়েব করে দেয়।
বিমানের তদন্তকারী সংস্থা সুত্রে জানাগেছে রঞ্জু ও সিনহা একাজে বিপুল অংকের টাকা পেয়েছে লন্ডস্থ ওই দুই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। অভিযোগ আছে রঞ্জু ও সিনহা বিমানের প্রায় স্টেশনের হোটেলগুলোতে এভাবে ব্যবসায়ীদের ডেকে এনে কেবিন ক্রুদের ওপর পাসবিক নির্যাতন চালিয়ে আসছিল। কিন্তু লোক লজ্জা ও চাকরী হারানোর ভয়ে কেউ মুখ খুলত না।
জানাগেছে লন্ডনস্থ হনস্লু এলাকায় অবস্থিত এসটি যাইলস হোটেলে এই ঘটনাটিও ছিল পুর্ব পরিকল্পিত। তদন্তকারী সংস্থা সুত্রে জানাগেছে রঞ্জু ও সিনহা মোটা অংকের টাকা নিয়ে ওই দুই ব্যবসায়ীকে আগে থেকে তাদের হোটেলের কক্ষে এনে রেখেছিলেন। এদের বিরুদ্ধে এর আগেও অনেক কেবিন ক্রুর ওপর এধরনের নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।
লন্ডনের ঘটনর সব তথ্য-প্রমাণ এখন বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হাতে। জানাগেছে বিমানের প্রশাসন শাখার একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ঘনিষ্ট হওয়ায় কৌশলে সিনহাকে চাকরীচ্যুত না করে বাচানোর চেষ্টা চলানো হচ্ছে।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে লন্ডনের যাইলস হোটেলে চিফ পার্সার নুরুজ্জামান রঞ্জু ও স্টুয়ার্ড অপুক মুমের সিনহা হোটেল কক্ষে বিমানের এক কেবিন ক্রুকে গণ যৌন নির্যাতন করে। ঘটনার পর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চালান দুই অভিযুক্ত। কিন্তু বিমানের গঠিত তদন্ত এই দু’জনের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে, যা এখন বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাইল হেউডের হাতে।
তদন্ত কমিটি এদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এদের দুইজনকেই চাকরিচ্যুতির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে রঞ্জু‘র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও এখনো সিনহাকে চাকরীচ্যুত করা হয়নি। অভিযুক্ত দু’জনকে আর ফ্লাইটে পাঠানো হবে না। তাদের গ্রাউন্ডেড করা হয়েছে।
নুরুজ্জামান রঞ্জুর বিরুদ্ধে এর আগেও এ ধরনের অভিযোগ ছিল। অভিযোগ আছে বিমানের অধিকাংশ ফ্লাইটের চিফ পার্সারকে খুশি না রাখলে কেউই (মহিলা কেবিন ক্রু) ভালো ফ্লাইটে যেতে পারেন না। তার রিপোর্টের ওপরই নির্ভর করে একজন কেবিন ক্রু’র পারফরম্যান্স। যে কারণে চিফ পার্সারের বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলতে পারেন না কোনো কেবিন ক্রু।
এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অতীতেও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, রঞ্জু তার অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এজন্য কয়েকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েও পার পেয়ে যান তিনি। তবে এবার বিমানের শীর্ষ পর্যায়ে ঘটনাটি জানাজানি হলে শেষ রক্ষা হয়নি তার।
সেদিন যা ঘটেছিল
বিমানের ঢাকা-লন্ডনে ফ্লাইটে ডিউটি ছিল ওই কেবিন ক্রুর। ফ্লাইটটি লন্ডনে পৌঁছানের পর ককপিট ক্রু (বৈমানিক) ও কেবিন ক্রুরা হোটেলে পৌঁছে। রাতে চিফ পার্সার রঞ্জু বিমানের সদ্য চাকরিতে ঢোকা ওই কেবিন ক্রুকে তার কক্ষে ডাকেন। এতে ভয় পেয়ে যান ‘না’ আদ্যক্ষরের ওই কেবিন ক্রু।
তাৎক্ষনিক বিষয়টি তিনি তার এক সিনিয়র মেয়ে কলিগকে জানান এবং কি করবেন এ বিষয়ে পরামর্শ চান। ওই মেয়ে কলিগ তাকে রঞ্জুর নাম শুনে তাৎক্ষনিক ওই রুমে যাওয়ার পরামর্শ দেন। অণ্যথা চাকরী হারানোর ভয় দেখান। এতে আরো ভয় পেয়ে যান ভিকটিম কেবিন ক্রু। কিন্তু তারপরও তিনি রঞ্জুকে টেলিফোন করে তার কক্ষে যেতে পারবেন না বলে জানান। যেতে রাজি না হওয়ায় রঞ্জু তাক অভয় দিয়ে বলেন, শুধু তুমি না, তোমার সঙ্গে আরো একজন কেবিন ক্রু থাকবে তাদের সঙ্গে। এরপর রাতে সবাই মিলে এক সঙ্গে ডিনার করবেন বলেও জানান।
এক পর্যায়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডাকায় বিষয়টিতে না করতে পারেননি ওই কেবিন ক্রু। এরপর তার কক্ষে গিয়ে দেখেন শুধুই সে, সিনহা ও দুই অপরিচিত লেঅক ছাড়া আর কেউ নেই ওই কক্ষে। তার বসকে আরেক সহকর্মী আসার কথা জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে রঞ্জু জানায়, আসবে। একথা বলে চিফ পার্সার অচেতন করা ওষুধ মেশানো কোমল পানীয় খেতে দেয়।
কেবিন ক্রু হালকা ঝিমুনি আসলেই রঞ্জু, সিনহা ও দুই অপরিচিত তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাষবিক নির্যাতন চালায়। মেয়েটি বারবার তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে রঞ্জু তার অধস্তন স্টুয়ার্ড সিনহাকে অচেতন অবস্থায় ওই কেবিন ক্রুকে তার কক্ষে দিয়ে আসতে বলে।
কক্ষে পৌঁছে দিয়ে এবার সিনহাও মেয়েটিকে যৌন নির্যাতনের চেষ্টা চালায়। দুই দফায় দুই সহকর্মীর ও দুই অপরিচিতের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে মুষড়ে যায় মেয়েটি। এরপর এই দুই ব্যক্তি মেয়েটিকে এ নিয়ে কোনো ধরনের রিপোর্ট না করতে শাসায়। এখানেই থেমে থাকেনি সে, রঞ্জু ওই মেয়ের পরিবারকেও হুমকি ধামকি দেয়, যাতে তারা বিষয়টি নিয়ে আর সামনে অগ্রসর না হয়।
কিন্তু পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে যায় এ খবর। এরপর রঞ্জু তার অ্যাসোসিয়েশনের শীর্ষ নেতাকে দিয়েও বিমানের উচ্চ পর্যায়ে তদবির করেন। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের একজন শীর্ষ নেতাও তার পক্ষ নিয়ে তদবির করেন।
এরপর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সেন্টারের (বিএটিসি) ডেপুটি ইন্সট্রাকটর ডালিয়াকে প্রধান করে কমিটি করে কর্তৃপক্ষ। তদন্ত কমিটি গঠনের পরেও রঞ্জুর হুমকি থেমে থাকেনি। তিনি ডালিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে সফলও হয়েছিল। তবে বিমানের শীর্ষ পর্যায়ের নজর থাকায় সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।