বিশ্বের ৩৫তম অর্থনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও স্কলারদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি। ২০৩৭ সালের মধ্যে আমরা ২০তম হব। পাশাপাশি ২০২৬ সাল নাগাদ আমরা একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হব।

২০৪১ সালের মধ্যে আমরা সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশা করছি।’ নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজিত অনুষ্ঠানে এক ভার্চুয়াল বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

‘বাংলাদেশ ইকোনমি অপরচুনিটিজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ বিষয়ক এই সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। মূূল বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আতিউর রহমান।

সঞ্চালনায় ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং নিউ ইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বিরূপাক্ষ পাল।

আলোচক প্যানেলে ছিলেন জাতিসংঘের ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ টিমের সাবেক প্রধান নজরুল ইসলাম, কলোরাডো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফরিদা খান, পরিবেশ ও পানি বিজ্ঞানী সুফিয়ান এ খন্দকার, মনমাউথ ইউনিভার্সিটির ডক্টর অব সোশ্যাল প্রগ্রামের ডিরেক্টর অধ্যাপক গোলাম এম মাতবর, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাইকেল স্টেকলার। সেমিনারে আরো বক্তব্য দেন স্টেট সিনেটর শেখ রহমান, স্টেট রিপ্রেজেন্টেটিভ আবুল বি খান এবং যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার মেলবোর্ন বরো শহরের মেয়র মাহবুবুল আলম তৈয়ব ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন।

অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি রাজনীতিতে এসেছি আমার পিতার স্বপ্ন অনুধাবন করে।

স্বপ্নটি ছিল বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। যেখানে প্রত্যেকটি নাগরিক স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে। আমরা এই স্বপ্নপূরণের পথে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছি। ২০২৬ সাল নাগাদ আমরা একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হব। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশা করছি।

তিনি আরো বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে গত সাড়ে ১৪ বছরে আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কল্যাণে ব্যাপক সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশ উন্নতি লাভ করেছে। উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি। ২০৩৭ সালের মধ্যে আমরা ২০তম হব। দারিদ্র্য বিমোচনে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১.৫ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার নেমে এসেছে ১৮.৭ শতাংশে। অতি দারিদ্র্যের হার এখন ৫.৬ শতাংশ। মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৭৬০ ডলারে।’

করোনা মহামারির পূর্বে আমাদের জিডিপি দাঁড়ায় ৬.৭ শতাংশে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা মহামারিকালে যেখানে অন্য দেশগুলোর উৎপাদন কমে যাচ্ছিল, সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩.৪৫ শতাংশ। এখন প্রবৃদ্ধির হার বেঁড়ে দাড়িয়েছে ৭ শতাংশে। শিল্প খাতে জিডিপি বৃদ্ধি পেয়ে ২২ থেকে ৩৭ শতাংশ হয়েছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৬ সালে গড় আয়ু ছিল ৫৯ বছর। এখন আমাদের গড় আয়ু ৭৩ বছর। একই সঙ্গে দ্রুত কমেছে শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার। দক্ষিণ এশিয়ায় লৈঙ্গিক সমতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন শীর্ষস্থানে। বাংলাদেশের জিডিপির আকার এখন ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ ২০০৬ সালে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন ডলার। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৬০ বিলিয়ন ডলার। বেকারত্বের হার নেমে এসেছে ৩.২ শতাংশে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে ৭৫.৬ শতাংশ। ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত আট লাখ ৪০ হাজারের বেশি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে আমরা বিনা মূল্যে জমি ও ঘর দিয়েছি। গত মাসে আমরাই দেশের প্রথম সর্বজনীন পেনশন চালু করেছি।’

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই পরিবর্তনগুলো কিন্তু এমনি এমনি আসেনি। আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনগণ, বিচক্ষণ পরিকল্পনা ও কার্যক্রম এই পরিবর্তনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তানের দেশভাগের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তেজোদীপ্ত আন্দোলন গড়ে তোলেন। অবশেষে ২৩ বছরের এক দীর্ঘ সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে বিজয় লাভ করে।’ তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের কাজ করছিলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে এবং আমার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের পরাজিত শক্তিরা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। জাতির পিতার হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ২১ বছরের জন্য সামরিক শাসনাধীন হয়ে পড়ে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে ছয় বছরের জন্য শরণার্থী জীবন যাপন করতে হয়েছিল। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা চিন্তা করে ১৯৮১ সালে আমি দেশে ফিরে আসি। আমার এই পথচলা সহজ ছিল না। কমপক্ষে ১৯ বার আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল এর মধ্যে অন্যতম। এই হামলায় আমার দলের ২২ জন নেতাকর্মী মারা যান এবং পাঁচ শতাধিক আহত হন।’

প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের প্রতি দেশের জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘জন্মভূমিকে ভুলে যেয়ো না। সর্বোপরি জন্মভূমিই আমাদের পরিচয়।’

অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্যে আতিউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির অসাধারণ রূপান্তরের গল্পটি আসলেই চমকপ্রদ। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ছিল এক ধ্বংসস্তূপ। বলা চলে শূন্য হাতেই বাংলাদেশ তার উন্নয়ন অভিযাত্রা শুরু করেছিল। তবে বড় সম্পদ ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দীপনামূলক নান্দনিক নেতৃত্ব। জাতিকে দেওয়া এই নেতৃত্বের লড়াকু মনই বাংলাদেশকে টেনে তুলে দেয় উন্নয়নের মহাসড়কে। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বড় কোনো ভুল কৌশল বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি।’

নিউ হ্যাম্পশায়ারের মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য আবুল বি খান বলেন, ‘৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান আইন প্রণেতা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যাহত আছে এবং আমি অনেকবার বাংলাদেশ সফর করেছি। ৪৩ বছর আগে দেশ ছেড়ে আসার পর থেকে বাংলাদেশ এখন যে পর্যায়ে উঠে এসেছে সেটি সত্যিই অসাধারণ। এটি ছিল একটি দীর্ঘ পথ, যেটি রাতারাতি ঘটেনি। খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নয়ন, উদ্যোক্তা বৃদ্ধি এবং নতুন ধারণার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বড় অর্জন করেছে বাংলাদেশ।’

এই সেমিনার ও সংলাপ আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবুল বি খান বলেন, ‘বাংলাদেশ আর তথাকথিত সেই তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। আমরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এই তকমা ঝেড়ে ফেলেছি।’

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.