চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) সাময়িক বন্ধ থাকা ছয়টি চিনিকল আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাভজনক করতে এবার বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিদেশী দেশগুলো হচ্ছে জাপান, থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তিনটি প্রতিষ্ঠান। জানাগেছে প্রাথমিকভাবে বিদেশীরা এই খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। পরবর্তীতে এই বিনিয়োগের পরিমান আরো বাড়বে।
এলক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে একটি চিনিকল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রায়াত্ব এই প্রতিষ্ঠানের নাম শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড। প্রায় তিন বছর বন্ধ থাকার পর ফের কলটি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)।
এদিকে বিদেশী কোম্পানীগুলো এসব চিনি কলে কত টাকা বিনিয়োগ করবে, সে বিনিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক করা যাবে কি না, বন্ধ কলগুলোর বর্তমান শ্রমিকরা কোথায় যাবে, প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের পরিমান কত ইত্যাদি যাচাই বাছাই করে সুপারিশ প্রদানের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটিও গঠন করেছে সরকার।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসএফআইসি) শীর্ষ আট কর্মকর্তাকে নিয়ে এই কমিটিটি গঠন করা হয়। বিএসএফআইসির উৎপাদন ও প্রকৌশল বিভাগের পরিচালককে এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে।
গত ৯ নভেম্বর সংস্থার ভারপ্রাপ্ত চিফ অব পার্সোনাল অফিসার শাহরীনা তানাজ স্বাক্ষরিত চিঠিতে কমিটিকে মতামত সংবলিত স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিবেদন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানের বরাবর পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানাগেছে, থাইল্যান্ডের সুটেক ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারকারা ইন্টারন্যাশনাল এবং জাপানের সোজিৎজ মেশিনারি করপোরেশন যৌথভাবে ছয় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এই চিনিকলগুলোতে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বিএসএফআইসি পরিচালিত এই চিনিকলগুলো যৌথভাবে পরিচালনার জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এনিয়ে একটি চূড়ান্ত প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এবং এক্সিম ব্যাংক অব থাইল্যান্ড এই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে। যৌথ উদ্যোগে তিনটি প্রতিষ্ঠান এই বিনিয়োগের ৩০ শতাংশ অর্থায়ন করবে এবং বাকি ৭০ শতাংশ আসবে ব্যাংক দুটি থেকে।
বিনিয়োগকারীদের স্থানীয় প্রতিনিধি মো. এমদাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা আট বছরের মধ্যে বিনিয়োগের অর্থ তুলে আনব।’ ‘এই উদ্যোগটি চিনি শিল্প ও কৃষকদের বাঁচাবে,’ যোগ করেন তিনি। এমদাদ হোসেন জানান, এই প্রকল্প থেকে সুগন্ধি ও ওষুধে ব্যবহার করার উন্নত মানের অ্যালকোহল উত্পাদন করা হবে। এসব উপজাত পণ্য মিলের আয় বাড়াতে সহায়তা করবে।
গত ২ ডিসেম্বর একটি সরকারি আদেশে পাবনা সুগার, রংপুরের শ্যামপুর সুগার, পঞ্চগড় সুগার, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ সুগার, রংপুর সুগার এবং কুষ্টিয়া সুগার পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের অক্টোবরে পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আখ, লিকার এবং বিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য এই তিন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করে বিএসএফআইসি।
প্রতিদিন ১৪ হাজার টন আখ প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি কারখানা স্থাপন করবে কোম্পানিগুলো। তারা রপ্তানির জন্য এক্সট্রা নিউট্রাল অ্যালকোহল (ইএনএ) তৈরি করতে উচ্চ মানের আখ উৎপাদন করবে। প্রসাধনী, পারফিউম, টয়লেট্রিজ এবং চুলের স্প্রে তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে ইএনএ ব্যবহৃত হয়।
এ ছাড়া, শিল্প খাতেও ইএনএ ব্যবহার করা হয়। মুদ্রণ শিল্পের কিছু ভার্নিস, রঙ এবং কালি তৈরির পাশাপাশি এন্টিসেপটিক, ড্রাগ, সিরাপ এবং স্প্রের মতো ওষুধজাত পণ্য উৎপাদনে এর ব্যবহার রয়েছে।
পাশাপাশি হুইস্কি, ভোদকা, জিন এবং লিকারের মতো অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় তৈরির প্রাথমিক কাঁচামাল ইএনএ।
আলাপকালে বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান জানান, করপোরেশন আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ছয়টি চিনিকলের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে এবং বিএসএফআইসি এই প্রকল্পের জন্য জমি দেবে বলে যোগ করেন তিনি। প্রকল্পের সম্পূর্ণ অর্থায়ন বিনিয়োগকারীরা করবে এবং মুনাফার ভাগ কীভাবে হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে বলেও জানান তিনি।
জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া এবং যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দেশের পুরাতন চিনিকলগুলোকে আধুনিকীকরণের সাতটি বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বিএসএফআইসি। সবগুলো প্রস্তাব বর্তমানে বিবেচনাধীন।
চেয়ারম্যান বলেন, মিলের আশেপাশের অঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে আখ সংগ্রহের প্রতিশ্রুতি বিএসএফআইসি রাখবে এবং মিলের কোনো শ্রমিক চাকরি হারাবে না। চালু থাকা অন্য চিনিকলে এই ছয় মিলের শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হবে।
সাময়িকভাবে বন্ধ থাকা এই ছয়টি মিলে প্রায় তিন হাজার শ্রমিক রয়েছে। পরিচালন ব্যয় কমানো এবং লোকসান কমাতে মিলগুলোকে অস্থায়ীভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত পাঁচ বছরে বিএসএফআইসি’র লোকসান হয়েছে তিন হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। শুধুমাত্র ২০১৯-২০ অর্থবছরে করপোরেশনের লোকসান হয়েছে ৯৭০ কোটি টাকা।
বিএসএফআইসির একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, আগামী নির্বাচনের পরপর নতুন সরকার ক্ষমতায় আসলে বিদেশী বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হতে পারে। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন দলের আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে খাদ্য নিরাপত্তা ও ফুড সিকিউরিটির বিষয়টি উপরের দিকে থাকবে। অবকাঠামো উন্নয়নের চেয়ে আগামীতে তারা খাদ্য নিরাপত্তা, ভোগ্য পণ্য মানুষের হাতের নাগালের রাখার দিকে বেশি টার্গেট থাকবে। সে লক্ষ্য নিয়ে বিএসএফআইসিও কাজ শুরু করেছে। তাদের টার্গেট বাংলাদেশে উৱপাদিত চিনি বিদেশে রফতানি করা এবং দেশের আখ শিল্প ও আখ চাষিদের জীবন মান উন্নত করা।