বিমানের লাপাত্তা দুই কর্মকর্তা সোনা ও মানব পাচারে জড়িত

সোনা ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন লাপাত্তা থাকা বিমানের দুই কর্মকর্তা। তাদের নাম সোহান আহমেদ ও আনোয়ার হোসেন। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিমানের বাণিজ্যিক তত্ত্বাবধায়ক সোহান আহমেদ এবং সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনোয়ার হোসেন কানাডায় পালিয়েছেন। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে। এসব পাচারের আশঙ্কা করছে বিমান কর্তৃপক্ষ। এতে বড় ধরনের ক্ষতি ও ঝুঁকিতে পড়তে পারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।

বিমান সূত্র জানায়, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২৪ অক্টোবর বিমানের বিজি-৩০৫ ফ্লাইটে সোহান আহমেদ এবং ৭ ডিসেম্বর বিমানের বিজি-৩০৫ ফ্লাইটে আনোয়ার হোসেন কানাডায় পালিয়ে যান।

তাদের কাছে বিমানের বিভিন্ন চুক্তিপত্র, আরআই পলিসি এবং সফটওয়্যারের তথ্য রয়েছে। তারা তথ্য পাচার করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। আনোয়ারের বাড়ি চাঁদপুরের নুনিয়া গ্রামে। তার বাবা আবুল মান্নান। আর সোহান রাজধানীর দক্ষিণখানের আশকোনা এলাকায় বসবাস করতেন। তার বাবা আনোয়ার হোসেন।

বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নির্বাহী কর্মকর্তা (এমডি ও সিইও) শফিউল আজিম বলেন, পলাতক দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের বিমানবন্দর অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জিডির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। থানায় জিডি করেছেন মাছুদুল হাসান। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ তাকে জিডি করতে বলেছে। এ কারণে তিনি জিডি করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২-৩ বছরে আনোয়ার নানা অবৈধ উপায়ে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, পলাতক আনোয়ারের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারি, মানব পাচার, সোনা চোরাচালানসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে কর্মরত বিমানের একজন প্রভাবশালী জেনারেল ম্যানেজারের (জিএম) টোল কালেকটর হিসাবেও আনোয়ার বিমানবন্দরে পরিচিত ছিলেন। তার কাছে ওই জিএমের মোটা অঙ্কের টাকা থাকতে পারে বলে জানা গেছে।

চুক্তিভিত্তিক কর্মরত প্রভাবশালী জিএমের কারণে আনোয়ারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারতেন না কেউ। পাসপোর্ট জালিয়াতি ও বোডিং কার্ড জালিয়াতি করে আনোয়ার প্রতিদিন গড়ে ২-৩ জনকে বিদেশে পাচার করতেন। প্রতিটি পাচার থেকে আনোয়ার ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে নিতেন। এরপর পুরো টাকা ভাগবাঁটোয়ারা হতো দুজনের মধ্যে। আনোয়ারের নেতৃত্বে শাহজালালে দুটি কোম্পানি বাইরে থেকে খাবারের প্যাকেট সরবরাহ করত। ট্রানজিট যাত্রীদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকায় এ খাবার বিক্রি করা হতো।

অভিযোগ-এ খাবারের প্যাকেটের মাধ্যমে আনোয়ার সোনা ও মুদ্রা পাচার করত। কিন্তু আইন অনুযায়ী কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাইরে থেকে কোনো খাবার পাঠানোর নিয়ম নেই। কিন্তু আনোয়ার আর বিমানের জিএম এ নিয়ম মানতেন না। অভিযোগ-আনোয়ারের অত্যাচারে বিমানের গ্রাহক সেবা বিভাগের একাধিক নারী কর্মী সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকতেন। কোনো নারী কর্মী তার কথার অবাধ্য হলেই রক্ষা পেতেন না।

২০১৯ সালে সিলেটের একটি আবাসিক হোটেলে তার হাতে বিমানের এক নারী কর্মী লাঞ্ছিত হওয়ারও অভিযোগ আছে। এর আগে বিমানের এক সংখ্যালঘু নারী কর্মীকে হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে বিনা অনুমতিতে একাধিকবার ভারত ভ্রমণের অভিযোগ আছে। বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আনোয়ারের যে গডফাদার, তার চাকরির মেয়াদ মার্চে শেষ হবে। আনোয়ারের কাছে ওই কর্মকর্তা গচ্ছিত টাকা ফেরত চাইতে পারেন-এ ভয়ে আনোয়ার চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেন।

একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), বাংলাদেশ বিমানসহ কয়েকটি এয়ারলাইন্সের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিমানবন্দরে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। তারা সোনা ও মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে সম্পৃক্ত। ইতোমধ্যে তাদের কাউকে কাউকে আইনের আওতায় আনা হলেও কৌশলে অনেকে অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে হযরত শাহজালাল ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসব অপরাধীচক্র বেশি সক্রিয়। কয়েক মাস আগে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে ৯০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে বেবিচককে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই এখনো কর্মরত।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৮০টি সোনার বারসহ সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ বেলালকে গ্রেফতার করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম জানালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

জানা যায়, বিমানবন্দরকেন্দ্রিক অপরাধীচক্রগুলোর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুটি প্রতিবেদন দাখিল করে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়। ওই তালিকায় ৯০ জনের নাম ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। কিন্তু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় পাঁচটি চিঠি দেওয়া হয়। বেবিচক জবাব দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

২৫ জুলাই আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়। বিমান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রোকসিন্দা ফারহানা স্বাক্ষরিত সর্বশেষ চিঠিতে বলা হয়, শাহজালাল বিমানবন্দরে সক্রিয় মানব ও সোনা পাচারকারী চক্র ও তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে গৃহীত অগ্রগতির বিষয়ে বেবিচক সর্বশেষ যে চিঠি দিয়েছে, তাতে প্রদত্ত তথ্যাদি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।

বেবিচকের জবাব পর্যালোচনায় দেখা যায়, মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠি অনুযায়ী বিদেশি এয়ারলাইন্সে কর্মরত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে মন্ত্রণালয় থেকে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে এ সংক্রান্ত তথ্য দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় বর্ণিত বিষয়ে বিদেশি এয়ারলাইন্সে কর্মরত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয় থেকে প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স কর্তৃক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ সংক্রান্ত তথ্য পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।

সূত্র : যুগান্তর

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.