বিমানের প্রকৌশল বিভাগ সোনার অবৈধ গোডাউন : আটক হল মেকানিক ইমরান

biman_arrest_837562746ঢাকা: বাংলাদেশ বিমােেনর প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই সোনা চোরাচালানের মুল হোতা। আর এই বিভাগটিই হল বিদেশ থেকে আসা সোনার অবৈধ গোডাউন। বিমান বন্দরের স্পর্শকাতর এলাকায় প্রকৌশল বিভাগের হ্যাঙ্গার শাখাটির অবস্থান হওয়ায় আইন শৃঙ্খলার বাহিনীর পক্ষে এই অবৈধ গোডাউনের কথিত সিকিউরিটি অর্থাৎ প্রকৌশল শাখার দুনীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কখনোই কবজা করতে পারে না। তারা সবসময়ই ধরা ছোয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে আইন শৃঙখলা বাহিনীর হাতে বিমানের সিডিউল বিভাগের সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হলেও প্রকৌশল শাখার গডফাদারদের ধরতে পারছে না কেউ। তবে মঙ্গলবার বিকালে এই ঘটনায় গ্রেফতার হন এয়ারক্রাফট মেকানিক ইমরান আলী। বিমানবন্দর কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে ইমরান আলীকে গ্রেফতার করেছে।

মঙ্গলবার (১০ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গত ১৪ জানুয়ারি ১৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় ইমরানকে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে উল্লে¬খ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হলো। বর্তমানে তাকে ঢাকার মগবাজারে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী কমিশনার উম্মে নাহিদা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

সুত্রে জানাগেছে বিমানের অধিকাংশ উড়োজাহাজ গড়ে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১১ ঘন্টার বেশি চলাচল করে না। গড়ে একটি ৭৭৭-৩০০ উড়োজাহাজ ১৬ থেকে ২০ ঘন্টা চলাচলের সুযোগ থাকলেও প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উড়োজাহাজের মধ্যে লুকানো সোনার বার বের করে নেয়ার জন্যই ইচ্ছা করেই ৮/৯ ঘন্টার বেশি ফ্লাই করতে দিচ্ছে না। একটি ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর পরই দ্রুত নানা ছল ছুতোয় উড়োজাহাজটি হ্যাঙ্গারে নিয়ে আসা হয়। এরপর উড়োজাহাজের নাট বল্টু খুলে বের করে আনা হয় তাদের আনা অবৈধ স্বর্ণালংকার। বাকী সময় উড়োজাহাজগুলো প্রকৌশল শাখার হ্যাঙ্গারে অলস পড়ে থাকে।

পুলিশ সুত্র জানায় বিমানের ভিতরে লুকানো অবস্থায় আসা প্রতিটি সোনা চোরচালানের সঙ্গে কোন না কোন ভাবেই প্রকৌশল শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত। আর এই চোরাচালানের ভাগ পায় প্রকৌশল শাখার টপ টু বটম। তবে মুল গড ফাদার হলেন প্রকৌশল শাখার ডেপুটি চীফ ইঞ্জিনিয়ার জিএম ইকবাল। মুলত তার নেতৃত্বেই প্রতিটি উড়োজাহাজ খোলা ও মেরামত করা হয়। তার ইশারা ছাড়া কেউ উড়োজাহাজের গায়ে হাত দিতে পারে না। তার সঙ্গে অসংখ্য প্রভাবশালী ও দেশী-বিদেশী সোনা চোরাকারবারীদের ঘনিষ্টতা আছে। গোয়েন্দারা এই বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলেও শুল্ক ও গোয়েন্দা সুত্রে জানাগেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠিত তদন্ত কমিটি স্বর্ণ চোরাচালানে বিমানের ১৪ কর্মীকে চিহ্নিত করলেও অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ২৪ জুলাই ১২৪ কেজি স্বর্ণবার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দারা। এ সোনার মূল্য প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাসহ সোনা চোরাচালানের সঙ্গে কারা জড়িত তা চিহ্নিত করার জন্য এনবিআর ২২ সেপ্টেম্বর একটি আন্তঃবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খানের নেতৃত্বে কমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে ৩৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, দেশের ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর এই স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় সংঘবদ্ধ অপরাধসহ নিরাপত্তা ঝুঁকি বিদ্যমান। এসব অপরাধীর সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে।

তদন্তে অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনই বিমানের প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ১২৪ কেজি সোনার বার আটকের আগে ২৬ এপ্রিল একই বিমানবন্দরে ১০৫ কেজি স্বর্ণবার আটক করা হয়। কমিটির মতে, এ দুটি ঘটনায়ই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে এয়ারক্রাফটের যাত্রী টয়লেটের প্যানেল স্ক্রু খুলে জাহাজের বডিতে (ফিউজলেজ) একটি ফাঁকা গর্ত দিয়ে কৌশলে কার্গো হোল্ডে স্বর্ণ বারগুলো রাখা হয়। বিমানবন্দরে কর্মরত বা এয়ারলাইন্সের কারও সহায়তা ছাড়া এ ধরনের চোরাচালান সম্ভব নয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানান, এই চোরাচালান সিন্ডিকেট শুধু চোরাচালানই নয়, এদের কারণে গোটা আকাশপথই এখন বড় ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২৪ কেজি স্বর্ণবার এককভাবে কারও পক্ষে পাচার করা অসম্ভব। বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস, সিডিউলিং, অপারেশন ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের চোরাচালানি নেটওয়ার্ক সম্ভব নয়। তদন্তের প্রয়োজনে কমিটির সদস্যরা দুবাই এয়ারপোর্টও পরিদর্শন করেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, দুবাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কয়েক স্তরে বিন্যস্ত ও কঠোর। অনুমোদিত জিনিস ছাড়া এই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করা সম্ভব নয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দুবাই এয়ারপোর্ট সব পণ্যের জন্য উš§ুক্ত। এ সুযোগে একাধিক যাত্রী বা চোরাচালান চক্র হ্যান্ড লাগেজ হিসেবে স্বর্ণবারের চালানটি বিমানের ভেতরে নিয়ে আসে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.