চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসকে বিশ্বমানের কাস্টমস হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কর্ম পরিবেশ গড়ে তুলতে চান অটোমেটেড সিস্টেমে। বিদ্যমান অটোমেশন সিস্টেমকে পুরোপুরি ইউটিলাইজ করার উদ্যোগের কথাও জানান চট্টগ্রাম কাস্টমসের নতুন কমিশনার।
বুধবার বিকালে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস কার্যালয়ে একান্ত আলাপে দেশের রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় স্টেশন নিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা জানান হোসেন আহমেদ। গত রোববার তিনি চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এর আগে তিনি ঢাকা কাস্টমস কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ঢাকা কাস্টমস হাউসে সহকারি কমিশনার(এয়ারপোর্ট), যুগ্ম কমিশনার, চট্টগ্রাম বন্ড কমিশনারেট, সিলেট কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনার ও সর্বশেষ ঢাকা কাস্টমস কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সফলতার সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের কাজ করেছেন। সবসময় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।
হোসেন আহমেদ বলেন,‘গত বছর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে লক্ষ্যমাত্রা আদায় না হলেও আশা করছি এবার হবে।’
তিনি বলেন,‘চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে অটোমেটেড হলেও কিছু কিছু এখনো সনাতন পদ্ধতিতে হচ্ছে। অনেকটা গেইট কিপার পদ্ধতি রয়ে গেছে। কিন্তু আমরা রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট বেইজড পদ্ধতিতে কাজ করবো। ঝুঁকিপূর্ণ চালানটিকেই বেশি গুরুত্ব দেবো।’
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে একটি অটোমেটেড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি আছে। কিন্তু ইন্টেলিজেন্স বেইজড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট করা দরকার বলে মনে করেন তিনি। বললেন,‘যার প্রোফাইল হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। ’
“সাধারণ যেসব অনিয়ম ঘটে শুধু সেসব চিহ্নিত করবো তা নয়। যেটা করলে অল্প কাজে বেশি ফলাফল পাবো, সেটাকে আমরা খুব সতর্কভাবে প্রোফাইলিং করবো। ”
তিনি বলেন,‘প্রথম কাজ হবে আমদানিকারক, রফতানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, এইচএসকোড, সিপিসি (বিভিন্ন রেয়াতি সুবিধা) শিপিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রোফাইল তৈরি করা। এরমধ্যে কোনটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সেটা নির্ধারণ এবং কোনটা বেশি ইমপ্যাক্ট সেটাকে ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারণ করা। অর্থাৎ ডাটাবেইজ ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করে এটা করতে পারি। ’
চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার বলেন,‘প্রোফাইল তৈরি করতে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিট গঠন করা হবে। এখানে একটি ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস টিম থাকবে।’
ঢাকা কাস্টমস হাউসে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট চালু করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন,‘তবে এটা ওয়ার্ল্ড কাস্টমস স্ট্যান্ডার্ড নয়। কিন্তু চট্টগ্রাম কাস্টমসে ওয়ার্ল্ড কাস্টমসের যে মান তা অনুসরণের পাশাপাশি ইন্টেলিজেন্স বেইজড রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট ফলো করা হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো হবে বৈজ্ঞানিক। ’
সম্প্রতি সিঙ্গাপুর থেকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন বলে জানান তিনি। বললেন,‘প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এখানে ঘটাতে চাই। ’
ঢাকা কাস্টমস হাউসে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা হয় জানিয়ে হোসেন আহমেদ বলেন,‘এখানে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে হয় না। এটা ভালো দিক। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সেগুলোকে নজরদারিতে রাখা হবে। আর যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অতীতে অনিয়মে জড়িত থাকার কোন তথ্য নেই, সেগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ’
“কারণ একটি প্রতিষ্ঠানের একশটি কন্টেইনার যদি পরীক্ষার জন্য আটকে রাখি তাহলে মাসুল অনেক বেড়ে যাবে। এতে কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বেড়ে যাবে। কমপিটিটিভনেস কমে যাবে। সুতরাং সনাতন পদ্ধতিতে অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ম্যানুয়েলি ভুল হতে পারে। সব সময়তো মনে রাখা সম্ভব হবে না। তাই অটোমেটিক সিস্টেমে নিয়ে আসতে চাই। ”
ঢাকা কাস্টমস হাউসে প্রোফাইল তৈরি হয়েছে জানিয়ে নতুন যোগ দেয়া কমিশনার বলেন,‘এটা হলে কেবল ঝুঁকিপূর্ণগুলোই কায়িক পরীক্ষা করা হবে। ’
পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিটকে আরো সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট আধুনিক ব্যবস্থাপনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখানেও একটা টিম গঠন করা হবে। ’
ফটকের নিরাপত্তা জোরদার
কাস্টমস কমিশনার হিসেবে যোগদানের পর চট্টগ্রাম বন্দরে আকস্মিক পরিদর্শন করেন হোসেন আহমেদ। এসময় দেখতে পান রাত আটটা থেকে ১২টা পর্যন্ত বন্দরের ফটকগুলোতে কাস্টমস কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকেন না।
আলাপে আকস্মিক পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন,‘চট্টগ্রাম বন্দরের গেইটগুলোর নিরাপত্তা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। রাত আটটার পর অনেক সময় কাস্টমস কর্মকর্তারা থাকেন না। এ সময়ে পণ্য নিয়ে যে কেউ বেরিয়ে যেতে পারে। তাই সব সময় কাস্টমস কর্মকর্তাদের গেইটে থাকার নির্দেশ দিয়েছি ।’
তিনি বলেন,‘এলসিএল কন্টেইনার শেডের ভেতর খালাস হয়। এখানে কঠোর নজরদারি নেই বলে মনে হয়েছে। বিষয়টি কঠোরভাবে দেখার নির্দেশ দিয়েছি। একটি কন্টেইনারে একাধিক আমদানিকারকের পণ্য আসে। সেক্ষেত্রে পণ্যগুলো আনলোড হয়ে গেছে। সঠিক ওজনে নিয়েছে কিনা তা প্রমাণের কোন ব্যবস্থা নেই। ’
“কোনটা কোন দিকে যাচ্ছে। কন্টেইনার ভর্তি আসলো, নাকি খালি আসলো সেটা বুঝা যায় না। অনেক সময় দেখা যায় খালিই আসে। একটা কন্টেইনারে তিন চারটা ভাগ করে নিয়ে আসলো ১০ টনের অ্যাসেসম্যান্ট করলো। কম নিয়ে গেল না বেশি নিয়ে গেল তা বোঝার উপায় থাকে না। কিন্তু কনটেইনারের ভেতরে থাকলে ধরা যাবে। যখন বিভিন্ন নামে ভাগ হয়ে খালাস হয় তখন ওই জায়গায় মনিটরিং বাড়ানো দরকার। ”
এছাড়া যেসব জায়গায় মনোযোগ কম রয়েছে বলে মনে হয়েছে সেখানে নজরদারি আরো বাড়ানো হবে বলেও জানান তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দরে কী পরিমাণ কন্টেইনার আসে আর কী পরিমাণ খালাস হয় এ বিষয়টি সঠিকভাবে জানা জরুরি বলে মনে করেন কাস্টমসের শীর্ষ এ কর্মকর্তা। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান খুবই সতর্ক বলে জানালেন তিনি।
মামলা জট কমানো হবে
বন্দর-কাস্টমস ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মামলার জট কমানোর চেষ্টা করে যাবেন উল্লেখ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার বলেন,‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মামলা অন্য কোর্টে যাওয়ার আগে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার। এখানে ন্যায় বিচার পেলে অন্যখানে যাবে কেন। আমরা ন্যায় বিচারের চেষ্টা করবো। কারণ মামলা জটের কারণে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আটকে আছে। ’
যেখানেই বদলি হয়ে যান সেখানে মামলা কমানোর চেষ্টা করেন বলে জানান এ কর্মকর্তা।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চট্টগ্রাম কাস্টমসকে আরো এগিয়ে নেওয়ার জন্যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করার প্রত্যয়ের কথাও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫১৮ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৫