সময়োপযোগী নীতিমালা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সমন্বয়ের অভাবে মোবাইল সেট আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দিনের পর দিন নিম্নমানের মোবাইল সেট আমদানি করে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছে নামীদামি আমদানিকারকসহ অসাধু আমদানিকারকরা। আর নিম্নমানের পণ্য কিনে ঠকছেন ক্রেতারা। বাড়ছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে অপরাধের ঘটনাও।
অনুসন্ধানে মোবাইল আমদানিতে শুল্ক ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে সব উপায়ে মোবাইল আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করা সম্ভব তার কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে।
একাধিক মোবাইল আমদানিকারকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশীয় বাজারে নন-ব্র্যান্ডেড যে সব মোবাইল সেট পাওয়া যায় তার বেশীরভাগ চীন থেকে আমদানি করা হয়। এ সব মোবাইল সেট আমদানিতে কাস্টমসের এ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারিত নেই। ফলে আমদানিকারকের ঘোষণা দেওয়া মূল্যেই শুল্কায়ন করতে হয়। এর ওপর মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানির ঘটনাও আছে।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের ৮ এপ্রিল ফাইভস্টার ব্র্যান্ডের এফ৩০ (f30) ১০ পিস স্মার্টফোন প্রতিটি ৬ ডলার অর্থাৎ ৪৭২ টাকায় (১ ডলারে ৭৮.৭৭ টাকা ধরে) আমদানি করা হয়েছে। দেশের বাজারে এই ফোন একেকটি সাড়ে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। একই সময় ওই একই কোম্পানি টি৩০ (t30) মডেলের ১০ পিস মোবাইল সেট প্রতিটি সাড়ে ৬ ডলার অর্থাৎ ৫১২ টাকায় আমদানি করেছে। এ সেটটি দেশের বাজারে বিক্রি করেছে ৫ হাজার ১৫০ টাকায়।
অর্থাৎ ওই কোম্পানিটি আমদানি করা কম দামি মোবাইল সেট বেশী দামে বিক্রি করছে। আর বেশী দামি মোবাইল সেট কম দামে বিক্রি করছে। এতেই বোঝা যায়, কোম্পানিটি মোবাইল সেট আমদানিতে কী পরিমাণ গোঁজামিল দিয়েছে আর নিম্নমানের সেট বিক্রি করে ক্রেতাদের ঠকিয়েছে।
আবার গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি লাভা আইরিস৩৪৯এস মডেলের এক হাজার পিস মোবাইল সেট আমদানি করা হয়। এর শুল্কায়নযোগ্য মূল্য দেখানো হয়েছে ১৫ ডলার। দেশীয় বাজারে মোবাইলটি ৩ হাজার ২৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই একই মডেলের মোবাইল সেট ৩০ মার্চ আমদানি করা হয় ১০ ডলারে। ১৪ জুন আমদানি করেছে ১৫ ডলারে। এতে বোঝা যায়, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় সেট আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং করেছে।
তবে এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এত কম দামে স্মার্টফোন আমদানি সম্ভব নয়। বারফোনের (সাধারণ) সর্বনিম্ন আমদানি মূল্য হচ্ছে ৫ থেকে ৭ ডলার। তাদের মতে, ১৫ থেকে ২০ ডলারের নিচে স্মার্টফোন আমদানি সম্ভব নয়। এখানে আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণা দিতে পারেন। আবার এত কমসংখ্যক মোবাইল সেট কোনো রফতানিকারকই রফতানি করবেন না বলে তাদের দাবি।
ব্যবসায়ীদের মতে, অনেক মোবাইল সেট ব্যবসায়ী যে সব ফোন আমদানি করছেন তাতে যে ধরনের ফিচার থাকার কথা অনেক ক্ষেত্রে সে সব ফিচার থাকছে না। ক্রেতাদের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে এ সব নিম্নমানের পণ্য বিক্রি করছেন তারা। এতে ক্রেতারা ঠকছেন। এ জন্য সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা দায়ী। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবে নিম্নমানের মোবাইল সেটে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ফলে সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে নিম্নমানের মোবাইল সেট আমদানিতে তারা উৎসাহিত হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মোবাইল সেটের ধরনভেদে আলাদা আলাদা এইচএস কোড ও ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণ করে দিলে শুল্ক ফাঁকি কিছুটা হলেও কমবে। অর্থাৎ বারফোন, স্মার্টফোন, ট্যাবের জন্য পৃথক এইচএস কোড ও শুল্কহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া সেটভেদে ট্যারিফ ভ্যালু নির্ধারণ করলেও শুল্ক ফাঁকি কমবে।
এ প্রসঙ্গে মোবাইল ফোন আমদানিকারক এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হক বলেন, নিম্নমানের মোবাইল সেট বিক্রি বন্ধে বিটিআরসির নিয়মিত মনিটরিং থাকা উচিত। তাহলে বাজারে নিম্নমানের সেট বিক্রি সম্ভব নয়।
অপরদিকে মোবাইল সেট আমদানিতে বিটিআরসিতে আইএমইআই (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল স্টেশন ইক্যুইপমেন্ট আইডেন্টিটি) নম্বর দাখিল করা বাধ্যতামূলক হলেও এর সঠিক প্রয়োগ নেই। আমদানি করা সেটের আইএমইআই নম্বর সংশ্লিষ্ট কাস্টমস হাউসে পাঠানোর পর বিটিআরসির কাজ শেষ। এ সব আইএমইআই নম্বর এ্যাক্টিভেশন সিস্টেম না থাকায় মিথ্যা ঘোষণায় মোবাইল সেট আমদানি হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো আমদানিকারক বিটিআরসিতে এক হাজার আইএমইআই নম্বর দাখিল করে কাস্টমসের চোখ ফাঁকি দিয়ে ১ হাজার ১টি সেট আমদানি করলেও অতিরিক্ত ওই সেটটি দেশে চালানো যাবে।
আইএমইআই নম্বর কী?
আইএমইআই নম্বর হচ্ছে মোবাইল ফোনের শনাক্তকরণ নম্বর। এ নম্বরটি প্রতিটি মোবাইল ফোনের জন্য আলাদা আলাদা। এক ফোনের আইএমইআই নম্বরের সঙ্গে অন্য ফোনের আইএমইআই নম্বরের মিল নেই। এ নম্বরটি আমদানিকারকদের ব্রিটিশ এ্যাপ্রুভালস বোর্ড ফর টেলিকমিউনিকেশন্স থেকে কিনতে হয়।
আবার অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী দেশে আসার সময় একাধিক মোবাইল সেট নিয়ে আসেন। অসাধু আমদানিকারকরাও কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ম্যানেজ করে এ সব দামি মোবাইল সেট এনে থাকেন। আইএমইআই নম্বর এ্যাক্টিভেশনের ব্যবস্থা থাকলে অবৈধ পথে আনা এ সব সেট দেশে এনে চালানো সম্ভব হতো না। ফলে আমদানিকারকরা নিরুৎসাহিত হবেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র আইএমইআই নম্বর এ্যাক্টিভেট করার ব্যবস্থা থাকলে শুল্ক ফাঁকিসহ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব। কারণ আইএমইআই নম্বর প্রতিটি ফোনের জন্য আলাদা আলাদা। একই সেটে একাধিক সিম ব্যবহার করা সম্ভব হলেও আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ফলে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ- যেমন অর্থ দাবি করে হুমকি, চাঁদাবাজি, জ্বিনের বাদশার মতো প্রতারণা বন্ধ করা যেত। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের নিমিষেই শনাক্ত করা সম্ভব হতো। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির জনসংযোগ কর্মকর্তা জাকির হোসেন খান বলেন, মোবাইল ফোন আমদানির পর বিটিআরসি দৈবচয়নভিত্তিতে সেটের আইএমইআই নম্বর পরীক্ষা করে থাকে। কোনো অনিয়ম পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
তিনি আরও জানান, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফেক আইএমইআই নম্বর বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশনে এনআইডির (জাতীয় পরিচয়পত্র) ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে চালু হলে মোবাইলের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ অনেকাংশেই কমবে।