এভিয়েশন নিউজ: দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের সব কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে দেশের প্রথম বেসরকারি খাতের উড়োজাহাজ সংস্থা জিএমজি এয়ারলাইনস। বকেয়ার কারণে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সও (এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেশন) স্থগিত করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
তবে কার্যক্রমে না থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি আজো কুক্ষিগত করে রেখেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটের মূল্যবান ৮১টি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি, যা দেশের মোট ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সির ২০ শতাংশ। এতে কার্যক্রমে থাকা অন্যান্য দেশী এয়ারলাইনস আবেদন করেও চাহিদা অনুযায়ী ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সির অনুমতি পাচ্ছে না।
জানা গেছে, বন্ধ হওয়ার আগে ১১টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি ছিল জিএমজির। এসব রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য সাপ্তাহিক ৮১টি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি ছিল তাদের; যার মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে সাপ্তাহিক মোট ৬৪টি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সির ২১টিই দখল করে রেখেছে জিএমজি।
এ রুটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১৪টি, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ১৫টি ও রিজেন্ট এয়ারের ১৪টি সাপ্তাহিক ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি রয়েছে। ফলে লাভজনক বিবেচনায় বাংলাদেশ-ভারত রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য কার্যক্রমে আসা নতুন এবং পুরনো এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বাড়াতে পারছে না সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী ফ্লাইট পরিচালনার অনুমোদিত কোটা পূরণ হয়ে গেছে। এখন হয় নতুন করে ভারতের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে হবে অথবা ভারতে ফ্লাইট পরিচালনায় দেশী এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে-কমিয়ে নতুনদের সুযোগ করে দিতে হবে।
বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুরের মধ্যে ২৮টি ফ্রিকোয়েন্সির তিনটি, বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের ২১টির পাঁচটি, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার ৪২টির সাতটি, বাংলাদেশ-সংযুক্ত আরব আমিরাতের ১০৮টির ২১টি, বাংলাদেশ-ওমানের ১৪টির সাতটি, বাংলাদেশ-সৌদি আরবের ৩৫টির সাতটি, বাংলাদেশ-বাহরাইনের ১৫টির তিনটি, বাংলাদেশ-কাতারের তিনটি ও বাংলাদেশ-চীনের ১৪টির মধ্যে চারটি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ রয়েছে জিএমজি এয়ারলাইনসের অনুকূলে। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে ঢাকা-নেপাল রুটে সাত হাজার যাত্রীসীমায় যেকোনো সংখ্যক ফ্লাইটের মধ্যে ১ হাজার ১০০ যাত্রীসীমায় যেকোনো সংখ্যক ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি রয়েছে জিএমজি এয়ারলাইনসের।
এ প্রসঙ্গে বেবিচকের ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশন বিভাগের পরিচালক উইং কমান্ডার এসএম নাজমুল আনাম জানান, জিএমজি এয়ারলাইনসের অনুকূলে বরাদ্দকৃত ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সিগুলোর বিপরীতে তারা একটি রিট করে রেখেছে। ফলে চাইলেও ফ্রিকোয়েন্সিগুলো অন্য এয়ারলাইনসকে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
আর জিএমজির বিরুদ্ধে মামলা করা হলে সেটির নিষ্পত্তি হওয়াও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ কারণেই আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে বেবিচককে বন্ড দেবে জিএমজি। বন্ডে উল্লেখ থাকবে, ছয় মাসের মধ্যে যদি বরাদ্দকৃত ফ্রিকোয়েন্সিগুলো জিএমজি ব্যবহার করতে না পারে, তবে সেগুলো বাতিল করে অন্য এয়ারলাইনসকে বরাদ্দ দেবে বেবিচক। বন্ডে উল্লেখ করা সময়ের মধ্যে জিএমজি যদি অপারেশনে আসতে না পারে, তাহলে জিএমজির বিরুদ্ধে মামলাও করা হবে। পরবর্তী সময়ে ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সিগুলো অন্য এয়ারলাইনসকে বরাদ্দ দেয়া হবে।
এদিকে জিএমজির অনুকূলে বরাদ্দ থাকায় আবেদন করেও আন্তর্জাতিক রুটের কাঙ্ক্ষিত ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সির বরাদ্দ পাচ্ছে না দেশী এয়ারলাইনসগুলো। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত রুটে এয়ারলাইনস নভোএয়ার ১০টি এবং রিজেন্ট এয়ারওয়েজ সাতটি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি চেয়ে আবেদন করে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, জিএমজির অনুকূলে ভারতের ২১টি ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ থাকায় প্রস্তাব বিবেচনা করা যাচ্ছে না। একইভাবে ওমানে সাতটি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি চেয়েও বরাদ্দ পায়নি রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। এছাড়া জিএমজির দখলে থাকা অন্যান্য রুটেও ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি সংকট তৈরি হয়েছে। তবে দুই বছরের বেশি সময় কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ১১টি আন্তর্জাতিক রুটের মূল্যবান ৮১টি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি দখলে রেখেছে, যা বাংলাদেশের মোট ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সির ২০%।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিষয়টি পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জিএমজি এয়ারলাইনসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা শিগগিরই আবারো আমাদের কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছি। এ উদ্দেশ্যে এয়ারলাইনস ব্যবসায় সম্পৃক্ত বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের একটি করে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এসে জিএমজির বর্তমান সম্পত্তি ও বুকভ্যালু, বর্তমান সম্ভাব্য বাজারসহ অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে গেছে। আশা করছি, স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা ভালো কোনো খবর দিতে পারব।’ তবে জিএমজির অনুকূলে থাকা ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাহাব সাত্তারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, এয়ারলাইনস খাতে নতুন করে কার্যক্রম শুরু করতে চায় জিএমজি এয়ারলাইনস। এরই মধ্যে তারা বেবিচক ও বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছে। কার্যক্রম চালুর পাশাপাশি ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সিগুলো বাতিল না করার জন্য জিএমজির পক্ষে সাহাব সাত্তার একাধিকবার আলোচনাও করেছেন বেবিচকের সঙ্গে। যদিও প্রতিষ্ঠানটি তাদের সম্পদের প্রায় ৯০ শতাংশ বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে একদিকে সম্পদ বিক্রি, অন্যদিকে পুনরায় কার্যক্রম চালুর বিষয়টি সাংঘর্ষিক।
জিএমজি ২০১২ সালের ৩০ মার্চ পরিচালন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরিচালন কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার সময় তাদের মোট আটটি উড়োজাহাজ বহরে ছিল। বর্তমানে তারা সব উড়োজাহাজ বিক্রি করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা এবং বিমানবন্দরে প্রতিষ্ঠানটির দাফতরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নির্ধারিত জায়গাও কমিয়ে এনেছে। এছাড়া উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আর ব্যাংকের ঋণখেলাপি হওয়ার পাশাপাশি বেবিচকের বিপুল অঙ্কের অর্থ বকেয়া পড়েছে জিএমজি এয়ারলাইনসের।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত বেবিচকের কাছে জিএমজির বকেয়া প্রায় ১৩৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দর ব্যবহার করে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল বাবদ এ অর্থ বকেয়া পড়েছে; যা নিয়ে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে মামলা করেছে বেবিচক; বর্তমানে তা বিচারাধীন। এছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের এ প্রতিষ্ঠানের কাছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পাওনা ৩১৪ কোটি টাকা; যা দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী। এ ঋণের বিপরীতে কোনো জামানত নেই। তবে বেক্সিমকো গ্রুপের করপোরেট গ্যারান্টি রয়েছে।
জিএমজি ১৯৯৮ সালের ৬ এপ্রিল বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা করে। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা করলেও ২০০৪ সালের ৬ এপ্রিল চট্টগ্রাম-কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রা করে সংস্থাটি। শুরু থেকে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রুটগুলোয় সুনাম কুড়ালেও পরে তা ধরে রাখতে পারেনি এ উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠান।
এর আগে ২০০৯ সালে জিএমজির সিংহভাগ শেয়ার কিনে নেয় বেক্সিমকো গ্রুপ। এর পর জিএমজির শেয়ার ছাড়তে রোড শো করে প্রতিষ্ঠানটি। জিএমজির শেয়ার শেয়ারবাজারে না এলেও প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য কোম্পানির প্রসপেক্টাস স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দেয়। এজন্য তারা জনতা ক্যাপিটাল অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডকে ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেয়।
২০১২ সালের ৩০ মার্চ উড়োজাহাজের কারিগরি পর্যবেক্ষণে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে সব ফ্লাইট বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় জিএমজি। কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, উড়োজাহাজগুলো উড্ডয়ন উপযোগী হলেই পুনরায় ফ্লাইট চালু হবে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতা ছাড়া আন্তর্জাতিক সব রুট বন্ধ করে দেয় এয়ারলাইনসটি। মূলত ২০১১ সালের বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রুটগুলো একে একে বন্ধ করে দেয় জিএমজি।
বণিক বার্তার সৌজন্যে।