ওরিয়নের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে স্পষ্ট জবাব চায় ইউনেস্কো

base_1476905379-14801132_1491388514210316_1063104268_nসুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান-বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। অথচ সুন্দরবনের আরো কাছে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরত্বে মংলার বুড়িরডাঙ্গায় ৬৩০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান ওরিয়ন। নিজেদের ওয়েবসাইটেও ওরিয়ন পাওয়ার খুলনা লিমিটেডের (ওপিকেএল) কাজ শুরুর কথা জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগের তরফ থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে।

সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎপান্দ্র বিশ্ব ঐতিহ্য এ ম্যানগ্রোভ বনের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা জানতে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র (ডব্লিউএইচসি) ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) যৌথ গবেষণা পরিচালনা করে। গত মঙ্গলবার এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে ইউনেস্কো।

সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও সেগুলোর পরিবেশগত ছাড়পত্রের বিষয়ে সরকারের বক্তব্য জানতে চায় ইউনেস্কোর প্রতিনিধি দল। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, ওরিয়নের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিকল্পনার পর্যায়েই ছিল। যদিও এটির কোনো অনুমোদন নেই। স্বাধীন, বিজ্ঞানসম্মত ও সমন্বিত পরিবেশগত সমীক্ষা ছাড়া কোনো শিল্প বা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে না। ওরিয়নের বিদ্যুৎকেন্দ্রটিও এর ব্যতিক্রম নয়।

তবে ওরিয়নের প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে সরকারের এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেনি ইউনেস্কো। সংস্থাটি বলছে, সুন্দরবনের সন্নিকটে ওরিয়নের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির হালনাগাদ তথ্যে অসামঞ্জস্য রয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে ওরিয়নের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে প্রতিনিধি দলকে অবহিত করা হলেও ওরিয়নের ওয়েবসাইটে উল্লেখ রয়েছে, এরই মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ স্থগিত বা বাতিলের বিষয়ে কোনো তথ্য ওয়েবসাইটে নেই। এছাড়া প্রতিনিধি দল স্থানীয় এক অংশীদারের কাছ থেকে জানতে পেরেছে, নির্মাণকাজ এগিয়ে নিতে সম্প্রতি তহবিল বরাদ্দও পেয়েছে ওপিকেএল।

গতকাল ওরিয়নের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও ওপিকেএলের কাজ শুরুর কথা উল্লেখ আছে। ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, এরই মধ্যে ওপিকেএলের কাজ শুরু হয়েছে। এটি স্থাপনে ইউরোপের অলস্টমের প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিবেশগত ও সামাজিক প্রভাব সমীক্ষা পরিবেশ অধিদপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রকৌশল ও অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বাণিজ্যিক উত্পাদনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করা হয়েছে ২০১৮ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিক।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেন, ওরিয়ন এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পরিবেশ ছাড়পত্র পায়নি। আর পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ নেই।

তবে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে ওরিয়নকে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে, তা পূরণ করতে পারবে না প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে সরকার থেকে এরই মধ্যে ওই এলাকায় ওরিয়নকে সৌরবিদ্যুৎ উত্পাদনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত তাদের অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানায়নি।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা শাখা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে হলে যেকোনো প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশগত ছাড়পত্র (ইআইএ) নিতে হয়। কিন্তু ওরিয়ন এখন পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি। কবে নাগাদ পাবে তারও নিশ্চয়তা নেই।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল (ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট) সুন্দরবন পৃথিবীখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। একই সঙ্গে বিরল প্রজাতির ডলফিন, কচ্ছপ, পাখিসহ অসংখ্য বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র এ বনাঞ্চল। অগণিত মানুষের জীবন এ বনের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় এ বনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে হিসাবে আসছে বছর এ গৌরব অর্জনের ২০ বছর পূর্তি হচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের মার্চে ডব্লিউএইচসি ও আইইউসিএন এ গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি সংরক্ষণে নেয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পর্যালোচনায় একটি রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশনে (আরএমএম) নামে। এরই অংশ হিসেবে গত মার্চে বাংলাদেশ সফরে আসে ইউনেস্কোর একটি প্রতিনিধি দল।

পরিদর্শন শেষে তৈরি প্রতিবেদনে ইউনেস্কো বলেছে, সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সেখানকার মিঠা পানির প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাবে। এতে বাড়বে পলি জমার হার ও লবণাক্ততা, যা পুরো বাস্তুতন্ত্রকেই ভয়াবহ হুমকিতে ফেলবে।

সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন আগামী ১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছে ইউনেস্কো। বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এক পৃষ্ঠার একটি সারাংশ অন্তর্ভুক্ত করারও অনুরোধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ প্রতিবেদন জমা দিলে তা ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় অধিবেশনে পর্যালোচনা করবে ডব্লিউএইচসি। ওই অধিবেশনেই সুন্দরবনকে ঝুঁকিগ্রস্ত বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা দেয়া হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

গতকাল বিকালে এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, সুন্দরবন ঘিরে বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে ইউনেস্কো যেসব আপত্তি তুলেছে, আমরা তার জবাব দিয়েছি। বাকিটা সরকারের সিদ্ধান্ত। এত দিন মনে হয়েছিল ব্যাপারটি শুধু পরিবেশের জন্য। কিন্তু এখন যেভাবে চলছে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে। মনে হচ্ছে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবেই তারা এটি নিতে চায়।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.