এভিয়েশন নিউজ: বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একটি সরকারী বিমান সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এর প্রায় ২৪ বৎসর পর ১৯৯৫ সালে এদেশে প্রথম যাত্রীবাহী বেসরকারী বিমান সংস্থা চালু হয়। পরবর্তী ১৫-১৬ বছরে বেশ কয়েকটি যাত্রীবাহী বেসরকারী বিমান সংস্থার আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, নভো ও রিজেন্ট ছাড়া বাকী সবগুলোই একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। এসময়ের মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই নয় বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই বিমান সংস্থাগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়ে।
বিমান ব্যবসার এই অবস্থার জন্য শুধুমাত্র অদক্ষ ব্যবস্থাপনা দায়ী তা নয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক রুট পরিচালনাকারী বাংলাদেশের বিমান সংস্থাসমুহকে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হয় তা হলো অসম প্রতিযোগিতা, তেলের দামের পার্থক্য, বিমানের যন্ত্রাংশ আমদানি ও রক্ষনাবেক্ষন সামগ্রী আনয়ন সমস্যা, বিমান বন্দরের উচ্চতর চার্জ ইত্যাদি। যার ফলে বাংলাদেশে একাধিক এয়ারলাইন্স চালু হওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বিমান ব্যবসায় প্রচুর মূলধন প্রয়োজন, কিন্তু বিবিধ কারণে বাংলাদেশের ব্যাংক বা অন্য আর্থিক সংস্থাগুলো বিমান ব্যবসায় অর্থায়ন করতে উৎসাহ বোধ করেনা। এতসব প্রতিকুলতা সত্ত্বেও ’ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেড’ তার কার্যক্রম সফলতার সাথে চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ১০ জুলাই ২০০৭ থেকে একটি ৩৭ আসনের ড্যাশ-৮ ১০০ সিরিজের এয়ারক্রাফট দিয়ে ঢাকা-সিলেট উদ্বোধনী ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়। এবং ২৪ শে সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে ঢাকা-কলকাতা ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এর যাত্রা শুরু করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। বর্তমানে ইউনাইটেড অভ্যন্তরীণ সেক্টরে ঢাকা থেকে সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, যশোর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও ঈশ্বরদীতে ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। এবং আন্তর্জাতিক সেক্টরে ঢাকা থেকে কলকাতা, কাঠমুন্ডু, কুয়ালা লামপুর, ব্যাংকক, সিংগাপুর, দুবাই, মাস্কাট, জেদ্দা এবং চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে।
আগামী ১৪ মে ঢাকা থেকে দোহা এবং জুন মাসে ঢাকা থেকে মদিনা ফ্লাইট শুরু করতে যাচ্ছে। এই প্রথম স্বাধীনতার পর কোনো বাংলাদেশী এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে সরাসরি মদিনা ফ্লাইট শুরু করতে যাচ্ছে। ইউনাইটেড সৈয়দপুর, রাজশাহী, বরিশাল ও ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় ৩০টি জেলাকে আকাশ পথে সংযোগ স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প বিকাশে সরকারের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। নানা প্রতিকুলতা, সংগ্রাম ও প্রতিযোগীতার মাধ্যমে মাত্র সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম এয়ারলাইন্সে পরিনত হয়েছে। বর্তমানে অত্র কোম্পানীর বহরে ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের মোট ১১টি এয়ারক্রাফট রয়েছে।
বাংলাদেশের পুঁজি বাজারে এভিয়েশন সেক্টরে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ একমাত্র পাবলিক লিমিটেড কোম্পানী। যা ২ জুলাই ২০১০ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম ষ্টক এক্সচেঞ্জে তালিকা ভুক্ত হয়। বৃহত্তর এ এয়ারলাইন্সে সহ¯্রাধিক লোকের কর্মসংস্থান করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শেয়ার হোল্ডার বিনিয়োগ করেছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে।
ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এ পর্যন্ত অভ্যন্তরীন রুটে প্রায় ১১ লক্ষ ও আন্তর্জাতিক রুটে প্রায় ৮ লক্ষ যাত্রী পরিবহন করেছে, প্রায় ৪৭ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছে এবং প্রায় ৫০০০টন কার্গো পরিবহন করেছে। ই্উনাইটেড এয়ারওয়েজ যখন ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করে তখন প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের জ্বালানী খরচ ছিল ০.৫৬ ইউএস ডলার এবং বর্তমানে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের জ্বালানী খরচ ১.০৭ ইউএস ডলার। পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জ্বালানী খরচ অনেক বেশী। উদাহরনস্বরূপ বর্তমানে মালয়শিয়ায় প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের জ্বালানী খরচ ০.৭৮ ইউএস ডলার। প্রতি লিটারে মালয়শিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে ০.২৯ ইউএস ডলার বেশী। যা কোনো এয়ারলাইন্সের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি করে থাকে।
বিমান পরিবহন সেবা খাতে টিকিট মূল্যের উপর একধরনের নিয়ন্ত্রন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে তা কার্যকর নাই। ফলে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স নিজেদের মধ্যে মূল্য যুদ্ধে (price war) অবতীর্ণ হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মালিন্দো, ফ্লাই দুবাই ও এয়ার এশিয়ার মত লো-কষ্ট এয়ারলাইন্সগুলির জনপ্রিয় রুটগুলিতে বিস্ময়করভাবে কমমূল্যে যাত্রী পরিবহন করছে। এই সমস্ত এয়ারলাইন্স এর অবিশ্বাস্য কম মূল্যে টিকিট বিক্রয়ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশী বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলো যাতে এ সমস্ত রুটে অপারেশন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এদের সংগে মূল্য যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সের আয় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এটি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কোন বেসরকারী এয়ারলাইন্স টিকে থাকতে পারবে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের লক্ষ্যে বেবিচক কর্তৃক সেক্টর প্রতি বিমান টিকিটের নূন্যতম মূল্য নির্ধারণ ও তা কার্যকর করলে এ অবস্থা থেকে উত্তরন সম্ভব।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে বেবিচক কর্তৃক ধার্যকৃত এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলির জন্য একটি বিশাল প্রতিবন্ধকতা। উদাহরনস্বরূপ, একটি এয়ারবাস এ-৩১০ এয়ারক্রাফ্ট যখন চট্টগ্রাম বা সিলেট থেকে ডমেষ্টিক ফ্লাইট শেষে ঢাকায় অবতরণ করে তখন বেবিচক এর পাওনা হয় ৩৩,৮৩২ টাকা কিন্তু এই একই এয়ারক্রাফ্ট যখন কলকাতা বা পৃথিবীর অন্য কোন এয়ারপোর্ট থেকে এসে অবতরণ করে তখন বেবিচক কর্তৃক এর বিল ধার্য করা হয় ১,৮৬,২৬৪ টাকা। ড্যাশ-৮, এটিআর-৭২ এবং এমডি-৮৩ এয়ারক্রাফ্ট এর ক্ষেত্রেও বিদেশ প্রত্যাগত ফ্লাইটগুলির জন্য ডমেষ্টিক এর তুলনায় প্রায় ৬ গুন বেশী বিল প্রদান করতে হয়। দৃশ্যত মনে হয়, বেবিচক কর্তৃক আন্তর্জাতিক রুটে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলির ফ্লাইট পরিচালনা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশী একটি এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশী রেজিস্টার্ড এয়ারক্রাফটের প্রধান অবস্থান স্থল হচ্ছে ঢাকা। যতবার ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট শেষে ঢাকায় ফিরে আসে ততবারই প্রতিটি এয়ারক্রাফটের জন্যই ডমেস্টিকের তুলনায় ছয়গুন বেশী চার্জ প্রদান করতে হয়। এ নিয়মের কিছুটা পরিবর্তন করা উচিত প্রতিযোগীতামূলক ব্যবসায় বাংলাদেশী বেসরকারী এয়ারলাইন্সের টিকে থাকার জন্য। অন্যদিকে, দেশীয় এয়ারলাইন্স এর এয়ারক্রাফ্ট হওয়া সত্বেও আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারি এয়ারক্রাফ্ট সমুহের পার্কিং চার্জ বিদেশী এয়ারলাইন্স এর এয়ারক্রাফ্ট এর সমহারে ধার্য করা হয়। এয়ারবাসের ক্ষেত্রে যার পরিমান ৪৯২ মার্কিন ডলার এবং এমডি-৮৩ এর ক্ষেত্রে ১৭৮ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে রেজিষ্ট্রিকৃত বাংলাদেশী মালিকানাধীন এয়ারক্রাফ্ট এর পাকির্ং চার্জ আন্তর্জাতিক রেটে ধার্য করা কোনভাবেই সমীচীন নয়।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ তাদের দেশের নিজস্ব এয়ারলাইন্স সমুহের বিকাশ সাধনের জন্য নানাবিধ সুযোগ বা ছাড় দিয়ে থাকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও তাদের দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোর টিকে থাকার স্বার্থে ৮০ আসনের নীচের কোন উড়োজাহাজের জন্য কোন ল্যান্ডিং চার্জ নেয় না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স সমূহ কখনই এ ধরনের সুবিধা পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নতুন এয়ারলাইন্সকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে মালয়শিয়া সরকারও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডকে মালয়শিয়ায় ৫ বছরের জন্য এ্যারোনটিক্যাল চার্জ মওকুফ করে দিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশে কোন প্রাইভেট এয়ারলাইন্স নিজ দেশ থেকে এই নূন্যতম সুবিধাটুকুও পাচ্ছে না। যার ফলে বাংলাদেশে একাধিক এয়ারলাইন্স চালু হওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
বর্তমানে চালু বেসরকারী বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ সবচেয়ে পুরানো এবং সবচেয়ে বেশী রুটে সবচেয়ে বেশী সংখ্যক ফ্লাইট পরিচালনা করে। শুধুমাত্র সরকারের রাজনৈতিক অংগীকার বাস্তবায়নের জন্য অলাভজনক হওয়া সত্বেও অত্র এয়ারলাইন্স বরিশাল, রাজশাহী, ইশ্বরদী ও সৈয়দপুরে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। অথচ, বেবিচক প্রদত্ত সূযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে সবচেয়ে কম প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।
অবিশ্বাস্য হলেও এটি বাস্তব যে অত্র এয়ারলাইন্স এর অভ্যন্তরীন ডমেষ্টিক চেক-ইন-কাউন্টারের জন্য সবচেয়ে কম জায়গা বরাদ্দ রয়েছে। অথচ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের ডমেষ্টিক কাউন্টারের চৌহদ্দির মধ্যে আর একটি এয়ারলাইন্সকে অতিরিক্ত আর একটি চেক-ইন কাউন্টার বরাদ্দ করা হয়েছে যাদের সর্বসাকুল্যে ফ্লাইট ডিপার্চারের সংখ্যা একদিনে অনধিক ৬টি। এটি ইউনাইটেডের যাত্রী সেবার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং যাত্রীদের চোখে অত্র কোম্পানীর অবস্থানকে হেয় প্রতিপন্ন করছে।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুয়াযী প্রত্যেক উড়োজাহাজের সিডিউল মেইনটেন্যান্স (সি চেক) করতে হয় এবং বাংলাদেশে এই অবকাঠামো গড়ে না উঠার কারনে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বাংলাদেশ বিমানসহ প্রত্যেক এয়ারলাইন্সকে বিদেশ থেকে তা করিয়ে আনতে হয়। এই খরচ হতে বাচাঁর জন্য ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ সকল প্রকার মান বজায় রেখে তার নিজস্ব জনবল দিয়ে “সি চেক” করার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু সিএএবি কর্তৃক কিছু শর্ত যেমন নিজস্ব হ্যাংগার থাকা, বিদেশী ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ ইত্যাদি আরোপ করায় তা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে।
অথচ ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ২০০৬ সাল থেকে নিজস্ব হ্যাংগারের জন্য কিছু জায়গা বরাদ্দ পাবার জন্য সিভিল এভিয়েশন এর সাথে নানান স্তরে প্রতিনিয়ত দেন-দরবার করে আসছে। অথচ, অত্যন্ত দুঃখের সাথে উল্লেখ্য যে, হ্যাংগারের জন্য অদ্যাবধি কোন জায়গা অত্র কোম্পানীকে বরাদ্দ করা হয়নি। হ্যাংগার না থাকার কারনে প্রয়োজন অনুযায়ী মেইনট্যানেন্স এর অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি বিধায় কোম্পানীর লক্ষ লক্ষ ডলার অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর পরে লাইসেন্সপ্রাপ্ত অনেক হেলিকপ্টার অপারেটিং কোম্পানীকেও হ্যাংগারের জন্য বিশাল জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছে যা কোনক্রমেই বোধগম্য নয়।
সাড়া বিশ্বজুড়ে হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া প্রায় প্রতিটি এয়ারলাইন্স নানা প্রতিকুলতার মধ্যে কোনরকমে টিকে আছে এবং ইতিমধ্যে অনেক বড় বড় এয়ারলাইন্স দেউলিয়া হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। এরকম একটি প্রতিকুল পরিবেশে শক্তিশালী বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে অসম প্রতিযোগিতা করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ টিকে আছে এবং এতদুর পর্যন্ত এগিয়েছে। এ পর্যায়ে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া আরো অগ্রসর হওয়া বা টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।
গত ২০ মার্চ ২০১৪ তারিখে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে জানিয়েছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর নিকট পাওনা সারচার্জসহ প্রায় ৫৮ কোটি টাকা কিন্তু ৬ই এপ্রিল ২০১৪ তারিখে ১৭দিনের ব্যবধানে সিভিল এভিয়েশন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে অবগত করেছে সারচার্জ বাবদ পাওনা ৭৭ কোটি টাকা। রেগুলেটরি অথরিটি একই অপারেটর এর কাছ থেকে ১৭দিনের ব্যবধানে অতিরিক্ত ১৯ কোটি টাকা বেশী দেখিয়ে যথোপুযুক্ত হিসাব নির্ধারন না করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তা প্রচার করা কতটুকু যুক্তিসংগত হয়েছে? ১৭ দিনের ব্যবধানে ১৯কোটি টাকার হিসাবের অসংগতি বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এটা কি রেগুলটরি অথরিটি কর্তৃক ইচ্ছাকৃত কোন অপারেটর এর সম্মানহানির চেষ্টা নাকি শুধুই হিসেবের ভুল?
সিভিল এভিয়েশনের হিসেব অনুযায়ী ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর কাছে ৭৭ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। যার মধ্যে মূল বকেয়া ৪৬.৩২ কোটি টাকা যার মধ্যে এম্বারকেশন ফি ৮.২৪ কোটি টাকা এবং কম-বেশী ৩২ কোটি টাকাই সারচার্জ। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, বেবিচকের বকেয়া পাওনা আগামী ৮ বৎসরের মধ্যে ৯৬ কিস্তিতে এম্বারকেশন ফি পরিশোধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সিভিল এভিয়েশনের বরাদ দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে ১১টি এয়ারক্রাফটের মধ্যে তিনটি এয়ারক্রাফট অচল। প্রকৃতপক্ষে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কোন এয়ারক্রাফটই অচল নয়। বর্তমানে ৩টি এয়ারক্রাফট রুটিন মেইনটেন্যান্স তথা সি-চেক এ আছে।
৬ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে সিভিল এভিয়েশন এর সম্মেলন কক্ষে মাননীয় সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এবং সিভিল এভিয়েশন এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে মতবিনিময় হয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। কিন্তু পরবর্তীতে সেই মিটিং এর কার্যবিবরনীতে কিছু অপ্রাসংগিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও সেই সব বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত ছিল না। কারন নতুন এয়ারক্রাফট ক্রয় কিংবা এয়ারক্রাফটের ডি-রেজিস্ট্রেশন না করানোর সিদ্ধান্ত ব্যবসায়িক। যা নেয়ার ক্ষমতা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পরিষদের, রেগুলেটরি অথরিটির নয়।
সিভিল এভিয়েশনের সিদ্ধান্তের দীর্ঘ সূত্রিতার জন্য, এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনোটিক্যাল ফি এর মাত্রাতিরিক্ত সারচার্জ ও ২০১৩ সালের দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের হিসেব অনুযায়ী পাওনা প্রায় ৭৭ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ পাঁচ কোটি টাকা প্রদান করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। অযোক্তিকভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে উদাহরন হিসেবে বন্ধ হওয়া জিএমজি, পারাবাতসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্সের কথা বলা হয় বেবিচক থেকে। বেবিচকের সময়োপযোগী কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহন না করার কারনে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাইভেট এয়ারলাইন্স ইতোপূর্বে বন্ধ হয়ে গেছে। এটা বেবিচকের গর্ব করার কোন বিষয় নয় বরং এটা দুঃখজনক এবং লজ্জাজনক ব্যাপার যেকোন রেগুলেটরী কর্তৃপক্ষের জন্য।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স বিভিন্ন কারনে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু দীর্ঘ ১৫-১৬ বছরে বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু এইসব বিমান সংস্থার অভিভাবক প্রতিষ্ঠান বেসামরিক বিমান পরিবহন চলাচল কর্তৃপক্ষ কি আদৌ এর অনুসন্ধান করে কিছু প্রস্তাবনা রেখেছে নাকি বন্ধ হওয়ার মিছিলে চলমান এয়ারলাইন্স গুলো যোগদান করবে তার অপেক্ষায় আছে? বেসরকারী বিমান পরিবহন সংস্থাগুলোকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের- অন্য কারো নয়। যখন থেকে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে তখন থেকেই বেশ কয়েকটি দাবী সব এয়ারলাইন্সের কাছ থেকেই ছিল।
সেগুলো হচ্ছে- জেট ফুয়েলে ভর্তুকি, এরোনোটিক্যাল ও নন-এরানোটিক্যাল চার্জ মওকুফ অথবা ভর্তুকি, এম্বারকেশন চার্জ কমানো, হ্যাঙ্গার সুবিধা, সি চেক ও ডি চেকের মতো হেভী চেকিং নিজ দেশে করার অনুমতি, এয়ারক্রাফটের পার্টস আমদানী নীতির সহজীকরন কারন প্রতিটি পার্টসই বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয় ইত্যাদি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এখন পর্যন্ত বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে কোন গঠনমূলক কর্মকান্ড দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে বেবিচকের কালক্ষেপনের দায়ভার বহন করছে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো। কারন দায়ভার বহন না করলে এয়ারলাইন্স বন্ধ করে দেয়া হবে যা রেগুলেটরি অথরিটির নিত্যদিনের রুটিন হমকির একটি হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এয়ারলাইন্সগুলোকে বন্ধ করার হুমকি না দিয়ে বরং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরীর প্রতি উদ্যেগী হওয়াই বাঞ্চনীয়। যেখানে বর্তমান সরকার প্রাইভেট সেক্টরকে ব্যবসা উপযোগী করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো বেবিচককে এইসব দাবী সংবলিত চিঠি দিয়েছে কিন্তু কোনটারই কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায় প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে তাদের দাবী সংবলিত চিঠি দিয়েছে। পরিশেষে সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর প্রাইভেট এয়ারলাইন্স ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর একটি চিঠির যৌক্তিক দাবীর প্রতি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং মন্ত্রণালয় উক্ত সিদ্ধান্তের আলোকে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর জন্য দেশের সকল অভ্যন্তরীন বিমানবন্দরের যাবতীয় এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ আগামী ৫ বছরের জন্য মওকুফ করার জন্য বেবিচককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করার নির্দেশ প্রদান করে যার কপি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও দিয়েছিল সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয়।
উক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান, মেম্বার অপারেশন সহ বিমান, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ সেই মিটিং এর ফলাফলের উপর ভিত্তি করে অভ্যন্তরীন বিমানবন্দরের যাবতীয় এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ আগামী ৫ বছরের মওকুফ সংবলিত চিঠির প্রত্যাশায় ছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সাত মাস পার হওয়ার পর গত ১৪ই মার্চ ২০১৩ তারিখে মন্ত্রণালয় পুনরায় সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে পুনরায় পূর্বের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করার জন্য তাগাদা দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বেবিচক সিভিল এভিয়েশন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে আরো ছয় মাস পর ৯ই অক্টোবর ২০১৩ তারিখে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কালক্ষেপন করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে শুধুমাত্র রুট নেভিগেশন, ল্যান্ডিং ও নিরাপত্তা চার্জ ২৪ জুন ২০১৩ থেকে তিন বছরের জন্য মওকুফ করে চিঠি দেয় এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রায় এক বছর পার করে দিয়েছে বেবিচক যা রেগুলেটরী অথরিটির কাছ থেকে কোন প্রতিষ্ঠান প্রত্যাশা করে না।
উল্লেখ্য যে, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ একমাত্র এয়ারলাইন্স, অলাভজনক হওয়া সত্বেও অভ্যন্তরীন সকল বিমান বন্দরে যাত্রী পরিবহন করছে। জনগণকে প্রদত্ত সরকারের অঙ্গিকার বাস্তবায়নে একাত্মতা প্রকাশ করে এবং সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছায় বরিশাল, ঈশ্বরদী, রাজশাহী ও সৈয়দপুর বিমান বন্দরে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সরকারের পক্ষ থেকে কাঙ্খীত সহযোগিতা পেলে আমরা এ সকল বিমান বন্দরে ফ্লাইট সংখ্যা বৃদ্ধি করা ছাড়াও দীর্ঘদিন যাবত অব্যবহৃত বিমান বন্দর গুলিতেও ফ্লাইট পরিচালনা করার পরিকল্পনা করছে। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য, বহু প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে অভ্যন্তরীন বিমান বন্দরে যে সকল চার্জ মওকুফ করা হয়েছে তার পরিমান দাঁড়ায় এক বছরে আনুমানিক সর্বাধিক দেড় কোটি টাকা। অথচ এ সকল বিমান বন্দর সমূহে নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনরা জন্য বাৎসরিক ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা কোম্পানী কর্তৃক ভর্তুকী দিতে হচ্ছে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজকে।
সিভিল এভিয়েশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার কাছ থেকে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা, বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ারলাইন্স জিএমজি এয়ারলাইন্স থেকে ১৩৪ কোটি টাকা, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর কাছে ৭৭ কোটি টাকা, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ এর কাছ থেকে ৭ কোটি টাকা এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ারলাইন্স এ্যারো বেঙ্গল এয়ারলাইন্স, এয়ার পারাবাত, বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এয়ারওয়েজসহ ফ্লাইট অপারোশন বন্ধ করা অনেক বিদেশী এয়ারলাইন্স এর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা পাবে বেবিচক। বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই সব এয়ারলাইন্স আদৌ পাওনা পরিশোধ করবে কিনা সন্দেহ? গত কিছু দিন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের এওসি নবায়ন নিয়ে বেবিচকের পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ। শর্তসাপেক্ষে প্রথমে সাতদিন পরে তিনমাস ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এওসি নবায়ন করে বেবিচক। বেবিচকের এই অপতৎপরতায় কে লাভবান হবে? সরকার, বেবিচক না যাত্রী সাধারণ।
রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বাংলাদেশ বিমান এর কাছ থেকে বেবিচকের বিপুল পরিমান বকেয়া জমা থাকলেও সিভিল এভিয়েশনকে কখনই বিমানের এওসি নবায়নের ব্যাপারে কালক্ষেপন করতে দেখা যায়নি। এধরনের দ্বিমুখীনীতি অবশ্যই যে কোন ব্যবসার জন্য প্রাইভেট সেক্টরকে নিরোৎসাহী করে তুলবে।
বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ দেশের প্রত্যেকটি বিমানবন্দরে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সকে বাৎসরিক চুক্তি মোতাবেক জায়গা বরাদ্দ দিয়ে থাকে। গত ২০০৮-৯ অর্থ বছরে প্রতি বর্গফুট জায়গার ভাড়ার চেয়ে ২০১৩-২০১৪ অর্থ বছরে জায়গার ভাড়া প্রায় দ্বিগুন। এধরনের ভাড়া বৃদ্ধি করার পূর্বে কোন প্রকার চিঠি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে না, যার ফলে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সগুলো অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।