দুই আম্পায়ার শলাপরামর্শ করে যখন রুবেলের বলে পরিস্কার ‘আউটের’ পরিবর্তে ‘নো’ কল করলেন তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পুলিশ শাখার একজন উর্ধ্বতন মহিলা কর্মকর্তা কেঁদেই ফেললেন। তিনি আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। এ যেন নিজ সন্তানের ওপর অশুভের আঘাতের দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃসিদ্ধ ও চিরায়ত অনুভূতির প্রকাশ। কোনোভাবেই তিনি এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিলেন না।
ক্রিকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে দুই আম্পায়ার যা ঘটালেন, তাতে এই আবেগ, রাগ, ক্ষোভ, ধিক্কার আর ঘৃণা কেবল প্রশাসনিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ের একজন রাশভারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তারই নয়, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে যারাই সরাসরি বা টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখেছেন তাদের প্রায় সবারই ছিল এই অনুভূতি। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল কিশোর-তরুণ-যুবা, বৃদ্ধসহ সবারই হƒদয়ে ঘটে রক্তক্ষরণ। বৃহস্পতিবার বিকালে যেখানে বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের আনন্দ-উৎসব করার কথা ছিল, সেখানে রাগ-ক্ষোভ একাকার হয়ে যায়। রাগে ফুঁসছে ক্রিকেট বিশ্ব। বিষাদ নমে এসেছে বাংলাদেশের মানুষের মাঝে। এর পেছনে আছেন ওই দুই আম্পায়ার- পাকিস্তানী আলিমদার এবং ব্রিটিশ ইয়ান গোল্ড।
গ্র“প পর্বে ইংল্যান্ডকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে। বিপরীত দিকে বাংলাদেশের কাছে হেরেই মূলত প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে ব্রিটিশরা। তাই একজন ব্রিটিশকে যখন কোয়ার্টার ফাইনালে আম্পায়ার করা হয়, তখন অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত যেতে পারে। সেই সংশয়ই শেষপর্যন্ত বাস্তব হল। একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গেলেন দুই আম্পায়ার, যা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যায়। এসব সিদ্ধান্তের আজ রাজসাক্ষী বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব। তাই আলাপে-আলোচনায়, সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে চলছে আম্পায়ারদের মুন্ডুপাত।
আম্পায়ারদের এই কাণ্ডে বিস্মিত খোদ ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ভিভিএস লক্ষ্মণ। ক্ষোভ ঝেড়েছেন অস্ট্রেলিয়ান বিশ্বসেরা সাবেক স্পিনার শেনওয়ার্ন। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক আশরাফুল বলেছেন, আম্পায়ারদের কারণে আমাদের ফিফটি-ফিফটি চান্স মাটি হয়ে গেলো। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই ‘বেনিফিট অব ডাউট’ পাই নি। আর আইসিসির সভাপতি আহম মোস্তফা কামাল বলেছেন, আমরা এ ব্যাপারে আইসিসিতে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাবো। প্রয়োজনে আইসিসি থেকে পদত্যাগ করবো।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনালের এই ম্যাচটি ছিল মূলত টাইগার ও তাদের ভক্তদের স্বপ্নের ম্যাচ। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হয় ম্যাচটি। খেলার ভেন্যু ছিল সেই সূদূর প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। কিন্তু সেখানকার খেলার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলাদেশে। যেন গোটা বাংলাদেশই ছিল মেলবোর্নের স্টেডিয়াম। অফিস-আদালতে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক, হাটে-ঘাটে-বাজারে সাধারণ ক্রিকেটভক্ত, বাসা-বাড়িতে গৃহিণীসহ দলমত-আদর্শ নির্বিশেষে প্রায় সবারই মন ছিলো খেলায়। কেউবা টেলিভিশনের পর্দায় আবার কেউ রেডিওতে শুনছিলেন ধারাভাষ্য। যিনি এই দু’টির কোনোটিতেই সংযুক্ত থাকতে পারেন নি, তিনি পাশের লোকটির কাছে জেনে আপডেট থেকেছেন খেলার সঙ্গে।
এই খেলাকে সামনে রেখে টেলিভিশন এবং টিভি কার্ড ও ইন্টারনেট মডেমের বিক্রি বেড়ে গিয়েছিল। ক্রিকেট পাগল অনেকে আগের রাত থেকে অপেক্ষা করছিলেন কখন সকাল হবে। যে কারণে খেলা শুরুর আগেই অনেকে টেলিভিশনের সামনে বসে থেকে অপেক্ষার প্রহর গুণছিলেন। খেলাকে ঘিরে প্রেমটা এতই নিবিড় ছিল যে, দিনমজুর-রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কোটিপতি শিল্প মালিক পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষ অনেকটাই কাজকর্ম বিমুখ হয়ে পড়েছিলেন। পারতপক্ষে অনেকেই বাইরে বের হননি। এমনকি হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা পর্যন্ত খেলার তথ্য জানতে ব্যকুল ছিলেন। একেবারে জরুরি কাজ যারা বাইরে বের হয়েছিলেন, তাদের অনেকে মোবাইল ফোনে কেউবা রেডিওতে আবার কেউ ইন্টারনেটে নানা মাধ্যমে খেলার তথ্য জেনেছেন। অনেকে মোবাইলে ক্রিকেটের আপডেট জেনেছেন।
যে কারণে রাস্তাঘাট তুলনামূলক ফাঁকা ছিল। আবার যে সংখ্যক যানবাহন রাজধানীর রাস্তায় দেখা গেছে, সেগুলোর বেশির ভাগ যাত্রীকে খেলার ধারাভাষ্য শুনতে বা দেখতে দেখা গেছে। রাজধানী জাতীয় স্টেডিয়াম পাড়াসহ সারাদেশেই বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে টেলিভিশনে খেলা দেখার ব্যবস্থা ছিল। দোকানে দোকানে এসব টেলিভিশনের সামনে সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সেখানে মালিক-কর্মচারীর কোনো ভেদাভেদ ছিল না। জাতীয় প্রেসক্লাবসহ সমস্ত ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনের দফতরে কোথাও বড় টিভি আবার কোথাও বড় পর্দায় খেলা দেখানো হয়।
খেলা নিয়ে মূল উম্মাদনা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বড় পর্দায় খেলা দেখানোর ব্যবস্থা ছিল। খেলার প্রথম অংশে বাংলাদেশের বোলার যখন এক একটা বল করতে যাচ্ছিলেন আর দর্শকরা এমনভাবে হর্ষধ্বনি দিচ্ছিলেন যেন তা ইথারে নিয়ে পৌছায় মেলবোর্নে। প্রথম দিকে যখন ভারতীয় দুই ব্যাটস মান দৃঢ়তার সাথে ব্যাটিং করছিলেন তখন কেউ কেউ দুয়োধ্বনিও দিচ্ছিলেন তাদের উদ্দেশে। আবার যখন চমৎকার লাইন-লেংথের বল হাঁকাচ্ছিলেন টাইগাররা, তখন আনন্দধ্বনিও দিচিছলেন তরুন-তরুনীরা।
কিন্তু রুবেল হোসেনের বলে রোহিত শর্মা তার ব্যক্তিগত ৯০ রানে যখন আউট হওয়ার পরও স্কয়ার লেগ অঞ্চল থেকে পাকিস্তানি আম্পায়ার আলিমদারের প্রথমে নো ডাকা এবং পরে মূল আম্পায়ার ইয়ান গোল্ডও যখন তাতে সায় দিলেন, তখন ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে গোটা টিএসসিতে। খেলা শেষে টিএসসির দর্শক মাহমুদুল হাসান নয়ন ক্ষোভের স্বরে বলছিলেন, রোহিত শর্মাকে ১৩৭ রান করতে দিয়ে দুই আম্পায়ার বাংলাদেশকে হারিয়ে পরাজয়কে নিশ্চিত করে ফেলে। মিরপুর থেকে আবদুল্লাহ আল মামুন টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, এটাকে আপনারা বাজে আম্পারিং লিখবেন না, লিখবেন উদ্দেশ্য প্রণোদিত আম্পারিং।
প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়েও খেলা নিয়ে ছিল বাড়তি উম্মাদনা। রুমে রুমে ছিল উসব আমেজ।রুটিন কাজের বাইরে এদিন কাজ কম হয়েছে। বিভিন্ন ভবনের রুমে রুমে কর্মকর্তা-কর্মচারী ভেদাভেদ ভুলে একসঙ্গে খেলা দেখেন। বাংলাদেশের বলারদের এক একটা আউট আর ব্যাটসম্যানদের ৪-৬ হাঁকার পর ওইসব রুমের অবস্থা অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের টিভি রুমের পরিবেশ ফিরিয়ে আনে। এসময় একজন বলেই ফেললেন, বাংলাদেশ তার শততম ও দ্বিশততম ম্যাচে জিতেছে। আজ ত্রিশততম ম্যাচেও জিতবে। ৬ নম্বর ভবনের এক সচিবের ব্যক্তগত কর্মকর্তা (পিএস) খাসি সদকা করার সংকল্প করেছিলেন। আরেকটি মন্ত্রণালয়ে একজন কর্মচারী বাসা থেকে ল্যাপটপ নিয়ে আসেন খেলা দেখার জন্য। নামপ্রকাশ না করে একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ জিতলে যে আনন্দযাত্রা হতো, বাইরে নেমে তাতে আমাদের যোগদানেরও পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিলেন দুই বিতর্কিত আম্পায়ার।
ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে মূলত তারুণ্যের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র। দুই আম্পায়ারের কীর্তি নিয়ে ফেসবুকেও কম যান নি তারুণ্য। ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই সর্বোচ্চ সাফল্যের ম্যাচ নিয়ে বৃহস্পতিবার দেশব্যাপী যে অভূতপূর্ব উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল, সেই দৃশ্য এরআগে যেন কেউ দেখে নি। যে কারণে স্বপ্নভঙ্গ মানুষের মতোই ক্রিকেট ভক্তদের ক্ষোভের টার্গেট খেলার প্রতিপক্ষ ভারত না হয়ে দুই আম্পায়ার হয়েছেন। আরিফুর রহমান নাইম নামে একজন লিখেছেন ‘এখন আইসিসির অর্থ দাঁড়াচ্ছে ইনডিয়ান চিটিং কাউন্সিল!’। তারেক মোরতাজা লিখেছেন, ‘খেলার দরকার ছিল না। তোরা আগে কইতি। আমাগো পুলাপাইন রেস্ট লইতো। খালি খালি এতগুলা মানুষরে মাঠে নামায় তোরা সার্কাস দেখাচ্ছিস ক্যান রে আইসিসি। তোরা যে চোর-বাটপারিকে শিল্প বানায়া ফালাইছোস- হেউডা আবার প্রদর্শনীর কি দরকার ছিল।’ মিজানুর রহমান নামে একজন লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্য যে কোনো প্রতিপক্ষ হারানো সম্ভব- কিন্তু এক ম্যাচে একইসঙ্গে ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড ও আইসিসিকে হারানো সম্ভব কি?’
এদিকে বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমিরা যখন এভাবে ‘বাজে’ আম্পারিংয়ের শিকার হয়ে বিষাদে ডুবেছিলেন তখন টাইগার ক্যাপ্টেন মাশরাফিকে এক ম্যাচের জন্য বহিস্কার ও ম্যাচ ফি’র ৪০ভাগ কেটে নেয়ার খবরে আগুনে ঘি ঢালার উপক্রম হয়েছে। যে কারণে টিএসসিতে খেলা শেষে একবার দুই আম্পায়ারের কুশপুত্তলিকা দাহের পর দ্বিতীয়বার আইসিসির বিরুদ্ধে ক্রিকেটপ্রেমিরা মিছিল করেছে।