আবেদন করা হয়েছে একটি বিমানচালক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের (হেলিকপ্টার পাইলট ট্রেনিং স্কুল) নামে। এ জন্য প্রয়োজন ১০ একর জমি। অথচ আবেদনকারী বেসরকারি কম্পানি ৫০ একর কৃষিজমি দখল করেছে। পাইলট ট্রেনিং স্কুলটির এখনো অনুমোদন দেয়নি সরকার। অথচ কম্পানিটি সেখানে রানওয়ে (বিমান ওঠানামার স্থান) তথা বিমানবন্দর নির্মাণকাজ শুরু করে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, সরকার কোনো বেসরকারি কম্পানিকে বিমানবন্দর নির্মাণের অনুমতি দিতে পারে না।
বিমানবন্দরটি তৈরি করা হচ্ছে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুরে। হেলিকপ্টার পাইলট ট্রেনিং স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করছে শিকদার গ্রুপের মালিকাধীন আর অ্যান্ড আর অ্যাভিয়েশন লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিমান ওঠানামার জন্য এরই মধ্যে রামভদ্রপুরের ইরি চাষের প্রায় ৫০ একর জমি দখল করেছে কম্পানিটি। এতে নির্মাণাধীন বিমানবন্দরটির দুই পাশের ছয়টি ইরি ব্লকের (প্রায় ১০০ একর জমি) চাষ বন্ধ হয়ে গেছে। ফসল ফলাতে না পারায় উৎকণ্ঠায় পড়েছে জমির মালিকরা।
আর অ্যান্ড আর অ্যাভিয়েশন ও স্থানীয় সূত্র জানায়, হেলিকপ্টার পাইলট ট্রেনিং স্কুল নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালে ব্যবসায়ী জয়নুল হক শিকদারের মালিকানাধীন আর অ্যান্ড আর অ্যাভিয়েশন লিমিটেড বিমান মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। আবেদনটি এখনো মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন।
গত ফেব্রয়ারি ও চলতি মার্চ মাসে তিন-চার দফায় রামভদ্রপুরের মধুপুর বিলে গিয়ে দেখা গেছে, মাটি কাটা ও মাটি ফিলিংয়ের কাজ চলছে। আর অ্যান্ড আর অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একটি ছোট (ডমেস্টিক) বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে এখানে। তারা তিন হাজার ফিট লম্বা ও ৩০০ ফিট প্রশস্ত করে অন্তত ৫০ একর জমি নিয়ে ছোট ছোট বিমান ওঠানামার জন্য একটি রানওয়ে নির্মাণ এবং আড়াই হাজার ফিট লম্বা ও ২০০ ফিট প্রশস্ত করে সি-প্লেন ওঠানামার জন্য একটি লেক নির্মাণের কাজ করছে।আইন না মেনে বিমানবন্দর!২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে রামভদ্রপুর-মধুপুর বিলের প্রায় ৫০ একর তিন ফসলি জমির ওপর লাল নিশানা পোঁতা হয়।
স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করে, ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণের জন্য প্রায় এক বছর আগে থেকে জমি ক্রয় শুরু করে তারা। রামভদ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশার সরদার তাঁর নিজের কিছু জমি প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিক্রি করেন। পরে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে জমি কিনে দিতে শুরু করেন তিনি। প্রতি দুই শতাংশ জমি ৪২ হাজার টাকা মূল্যে (যা বর্তমান বাজার মূল্যের অর্ধেক) প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিক্রি করতে মালিকদের বাধ্য করা হচ্ছে।
কম্পানিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে রামভদ্রপুর-মধুপুর বিলের প্রায় ৫০ একর তিন ফসলি জমির ওপর লাল নিশানা দিয়ে বিমানবন্দর নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করে তারা। মূল্য পরিশোধ না করে জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
রামভদ্রপুর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মজিবর রহমান সোহেল জানান, সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির নামে ১০ একর কৃষিজমির নামজারি করা হয়েছে। এর বেশি কিছু তাঁর জানা নেই।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, কৃষিজমি রক্ষা করতে সহায়তা চেয়ে ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করে তারা। দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে কম্পানির লোকদের চাপে কৃষকরা তাদের বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বনটুকু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
কৃষকরা জানায়, অপরিকল্পিতভাবে বিমানবন্দর নির্মাণকাজ শুরু করায় দুই পাশের ছয়টি ইরি ব্লকের প্রায় ১০০ একর জমি অনাবাদি হয়ে গেছে। ফসল উৎপাদন থেকে বঞ্চিত হয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে জমির মালিকরা। জমিগুলো আবাদ করা গেলে প্রায় ১০ হাজার মন ধান উৎপাদন করা যেত।
মধুপুর বিলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুল মান্নান মল্লিক, ফুল মালা বেগম, আব্দুল করিম শেখ, বাবুল সরদার, সাইফুল ইসলাম, আবুল কাশেম সরদার, মিন্টু সরদার বলেন, ‘শিকদার সাহেব অনেক ধনী, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর লোক। তাঁর লোকজন আমাদের জমির আশপাশে কিছু জমি ক্রয় করে সেখানে এয়ারপোর্ট নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এই জমিতে আমরা বছরে দুইবার ধান ও রবিশস্য আবাদ করতাম। উৎপাদিত শস্য দিয়ে আমরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খেয়েপরে বাঁচতাম। আমাদের মুখের আহার নষ্ট করে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে। আমরা আমাদের জমি রক্ষার জন্য ডিসি সাহেবের কাছে আবেদন করেছিলাম; কিন্তু কোনো ফল পাইনি। আমাদের প্রতিবাদ করার শক্তি ও সাহস না থাকায় এখন বাধ্য হয়ে তাদের নির্ধারিত দুই শতাংশ জমি ৪২ হাজার টাকা হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছি।’আইন না মেনে বিমানবন্দর! এখন জমি কেটে রানওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। ছবি দুটি সম্প্রতি তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ
রামভদ্রপুর গ্রামের আব্দুল হক সরদার বলেন, ‘নির্মাণাধীন বন্দরের মধ্যে আমাদের ১২৮ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির টাকা না দিয়েই তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। এভাবে জমি দখল করতে বাশার চেয়ারম্যান তাদের সহায়তা করেছেন। শুনেছি বাশার চেয়ারম্যান শিকদার সাহেবের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা লোনের সুবিধা পেয়েছেন।’
রামভদ্রপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বাশার সরদার বলেন, ‘জমি সংগ্রহ করার সময় আমি স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির জন্য কাজ করেছি। তবে জোর করে জমি নেওয়া হয়েছে, অভিযোগটি সঠিক নয়। অনাবাদি হওয়া জমির ক্ষেত্রে মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ফসলের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।’
আর অ্যান্ড আর অ্যাভিয়েশন লিমিটেডের প্রকল্প প্রকৌশলী মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘পাইলট ট্রেনিং স্কুলের হ্যালিপ্যাড ও স্থাপনার বাইরেও ছোট ছোট বিমান ওঠানামা করার জন্য রানওয়ে এবং সি-প্লেন ওঠানামার জন্য লেক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা ২৫-৩০ একর জমি ক্রয় করে নিয়েছি। বাকি জমি ক্রয়ের ব্যবস্থা চলছে। প্রকল্পের অভ্যন্তরে যেসব কৃষক তাদের জমি বিক্রি করতে ইচ্ছুক নয় তাদের বিকল্প জমি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমরা জোর করে কারো জমি ক্রয় করছি না বা কাউকে জমি থেকে উচ্ছেদও করছি না।’
ভেদরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘কৃষকদের অভিযোগের কথা শুনে দুইবার আমি রামভদ্রপুরের মধুপুর বিল পরিদর্শন করি। একটি প্রতিষ্ঠান সেখানে এয়ার অ্যাভিয়েশনসংশ্লিষ্ট একটি স্থাপনা নির্মাণের কাজ করছে। এ জন্য এ বছর থেকে বিলটির প্রায় ১০০ একর জমির ছয়টি বোরো খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এ এলাকায় বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার মণ ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে।’
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক রামচন্দ্র দাস বলেন, ‘রামভদ্রপুরের কিছু কৃষক আমার কাছে একটি আবেদন করেছে। আমি ভেদরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বিষয়টি খোঁজ নিয়ে জানাতে বলেছি। তবে রামভদ্রপুরে রানওয়ে নির্মাণের বিষয়ে কোনো পক্ষ আমাকে কিছু জানায়নি।’
এ বিষয়ে বেসরকারি বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. হামিদুর রহমান মুঠোফোনে বলেন, ‘আর অ্যান্ড আর অ্যাভিয়েশন লিমিটেড কেবল হেলিকপ্টার পাইলট ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য বিমান মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে। ১০ একর জমি ট্রেনিং স্কুলের নামে লিখে দিয়ে তার কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার পর কমিটি বিবেচনা করবে অনুমতি দেওয়া যাবে কি না। কিন্তু কোনো ডমেস্টিক বিমানবন্দর বা রানওয়ে নির্মাণের জন্য সরকার কোনো বেসরকারি কম্পানিকে অনুমোদন দিতে পারে না।’
