এভিয়েশন নিউজ: দেশে প্রায় প্রত্যেকদিন স্বর্ণের চোরাচালান উদ্ধার করা হচ্ছে। সব মিলে প্রায় ২২ টি চক্র এই সোনা চোরাচালানের সাথে জড়িত বলে জানিয়েছে বিমান বন্দরের কর্মরত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এছাড়া শুল্ক, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের (এনএসআই) একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীও এসব চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
সাম্প্রতিক সময়ে দুটি মামলায় আটক সোনা পাচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এমন তথ্য পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত ১৬ মাসে সারা দেশে দুই হাজার ২৭ কেজি সোনা উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অন্তত ৮০ জন। তবে এঁদের অধিকাংশই জামিনে বেরিয়ে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন সময়ে সোনাসহ আটক ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সোনা পাচারকারীদের কাছে বাংলাদেশ এখন একটি নিরাপদ রুট। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সোনা বাংলাদেশ হয়ে চলে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশের বাজারে। পাচার হওয়া সোনার কিছু অংশ মাঝেমধ্যে ধরা পড়ছে ঢাকার হজরত শাহজালাল ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে।
সোনা কেন পাচার হয়?
এ প্রশ্নের সহজ জবাব পাওয়া গেল শুল্ক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। তাঁরা জানালেন, বাংলাদেশে প্রতি ১০ গ্রামের জন্য শুল্ক দিতে হয় মাত্র ১৫০ টাকা। আর ভারতে ১০ গ্রামের শুল্ক চার হাজার টাকা। ১০টি সোনার বার ভারতে চোরাইপথে বিক্রি করতে পারলে প্রায় আট লাখ টাকার মতো লাভ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলামও পাচার হওয়ার একই কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রবাসীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে সোনা আসে, তা দিয়েই দেশের ১০ হাজার সোনার দোকান চলে। বৈধ পথে কোনো সোনা আমদানি হয় না।
পাচার করা এত সোনা কি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ধরা পড়ছে?
এই প্রশ্নে শুল্ক গোয়েন্দার এক কর্মকর্তা বললেন, বেশির ভাগ বড় চালানই নির্বিঘ্নে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তবে পাচারকারীদের মধ্যে যখন অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়, তখনই বড় চালান ধরা পড়ে। ওই কর্মকর্তা জানালেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিমানবন্দরে যে কয়টি বড় চালান ধরা পড়েছে, তার পেছনেও ছিল পাচারকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এই কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামে শাহ আমানত বিমানবন্দরে এর আগে ৪৯ কেজি সোনা আটকের পর প্রতিপক্ষকে সন্দেহ করে পাচারকারীরা। ক্ষিপ্ত এই পক্ষই পরে দুবাই থেকে আসা ১০৭ কেজি সোনা চালানের খবর শুল্ক গোয়েন্দাদের জানিয়ে দেয়। ফলে গত ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা মূল্যের ওই সোনার চালান আটক করা সম্ভব হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলেন, বাহকেরা ধরা পড়লেও চোরাচালানি চক্র ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। সোনা উদ্ধারের পর তাৎক্ষণিকভাবে ধরা পরা ব্যক্তিদের কাছ থেকে সহযোগীদের নাম জানা গেলেও মূল ব্যক্তিদের নাম জানা যায় না। সোনা উদ্ধারের ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার তদন্ত করার ক্ষমতা নেই শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের। মামলার তদন্ত করে পুলিশ। ফলে যাঁরা প্রথম অভিযান চালান, তদন্তে তাঁদের কোনো ভূমিকা থাকে না। চক্রের প্রধানদের শনাক্ত ও ধরতে না পারার জন্য শুল্ক কর্মকর্তারা এই ব্যবস্থাকে দুষছেন।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, সোনা আটকের ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। কিন্তু সোনার বড় চালানের মামলা তাৎক্ষণিকভাবে ডিবি তদন্ত করে। ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে তাঁরা ১৩টি চক্রের সন্ধান পেয়েছেন। আরেকটি মামলায় ভিন্ন আরেকটি চোরাকারবারি চক্রকে শনাক্ত করা গেছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাহকেরা ধরা পড়েন এবং তাঁরা যে সোনা দিয়েছেন, শুধু তাঁর নাম বলতে পারেন। যাঁর কাছে পৌঁছাবেন তাঁর নামও তাঁদের বলা হয় না। বলে দেওয়া হয়, ফোনে যোগাযোগ করে আপনার কাছ থেকে একজন নিয়ে যাবেন। ফলে পুরো চেইনটা ধরা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
গত সোমবার রাতে সিঙ্গাপুর থেকে (এসকিউ-৪১৯) একটি বিমানে দুই নারীসহ তিন যাত্রী শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। তাঁদের ২০ কেজি সোনাসহ আটক করা হয়। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বেসামরিক বিমান পরিবহনের তথ্য সহকারী মোবারক হোসেনকে আটক করেন। মোবারক শুল্ক ও ডিবি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানান, বেসামরিক বিমান পরিবহনের প্রটোকল সহকারী হাফিজুর রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি এঁদের (সোনা বহনকারী) ইমিগ্রেশন পার করে দিতে সহযোগিতা করেছেন। হাফিজুর ধরা পড়েননি। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় হওয়া মামলাটি তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সর্বশেষ গতকাল সকাল নয়টা থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে বিমানের একটি উড়োজাহাজের সাতটি টয়লেটের কমোড থেকে ১০৫ কেজি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের একজন যান্ত্রিক সহকারীকেও আটক করা হয়।
২২ চক্রের সন্ধান:
ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, ২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী মনোয়ারুলকে আটক করে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা (এপিবিএন)। পরে তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে টয়লেটের কমোড থেকে সাড়ে ১৩ কেজি ওজনের ১১৭টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় এনএসআইয়ের মাঠ কর্মকর্তা আবদুল আজিজ শাহ গ্রেপ্তার হন।
এঁদের তথ্যের ভিত্তিতে সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তাকর্মী কাজী আবুল কালাম, নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানকারী নিজাম খন্দকার ও চোরাচালানির মূল হোতা সোনা ব্যবসায়ী দেব কুমার দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই আটককৃতরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাচালানের সঙ্গে ২২টি চক্র জড়িত। এসব চক্রে আছেন নয়জন সোনা ব্যবসায়ী ও চারটি মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী। চোরাচালানে সহায়তা করেন এনএসআইয়ের কর্মকর্তা আজিজ শাহ, বেসামরিক বিমান পরিবহনের সাত কর্মী, শুল্ক বিভাগের দুজন রাজস্ব কর্মকর্তা।
নয় চোরাচালানি হলেন
দেব কুমার, মো. সেলিম, কাজী সিরাজ, আনিসুর রহমান, জহিরুল হক, সালাউদ্দিন, আমির হোসেন, ফয়েজ ও লোকমান।
চার মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী হলেন
ভাই ভাই মানি এক্সচেঞ্জারের সাবেক পরিচালক মিজানুর রহমান, দি ঢাকা মানি এক্সচেঞ্জারের মালিক নবী নেওয়াজ খান, প্যারামাউন্ট মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর ও আরেকজন মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী লুলু।
বেসামরিক বিমান পরিবহনের সাত কর্মী হলেন
মনোয়ারুল হক, কাজী আবুল কালাম, সেলিনা, রেখা পারভীন, নিজাম খন্দকার, মো. শাহীন ও নেসার।
দুই শুল্ক কর্মকর্তা হলেন
মইনুল ইসলাম ও সেলিনা আক্তার।
এই সোনা চোরাচালানের ঘটনায় দেব কুমার দাসসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এঁদের মধ্যে কয়েকজন জামিনে বেরিয়ে গেছেন। এই মামলায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। অপর চক্রটির সন্ধান মেলে রামপুরা থানার উদ্ধার করা সোনার সূত্রে। ওই চক্রের প্রধান জাহিদুল ইসলাম ওরফে অনীক। তাঁকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু উদ্ধার হওয়া সোনা আত্মসাতের মামলায় এখন তিন পুলিশ সদস্য কারাগারে।