বিদেশে যেতে ইচ্ছুক নারী কর্মীদের নাম নিবন্ধনের জন্য গত ৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু, এতে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। এ অবস্থায় নিবন্ধন কার্যক্রমের সময় ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
শুধু সৌদি আরবেই যেখানে মাসে ১০ হাজার নারী কর্মীর চাহিদার কথা জানিয়েছে দেশটির বেসরকারি জনশক্তি আমদানিকারক সংগঠন সানারকম। সেখানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া সময়ে নিবন্ধিত হয়েছেন ২ হাজার ৫৭০ জন নারী।
জনশক্তি রফতানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে জানা যায়, নির্ধারিত সময়ে ঢাকা বিভাগের ১ হাজার ১০০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৫০ জন, খুলনা বিভাগে ৪৫০ জন, রংপুর বিভাগে ৪২০ জন, বরিশাল বিভাগে ১৮০ জন এবং সিলেট বিভাগের ১৫০ জন নারী নিবন্ধিত হয়েছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার রবিবার রাতে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্ধারিত বেঁধে দেওয়া সময়ে দুই হাজার আটশ’র কিছু বেশি নারী নিবন্ধিত হয়েছেন। নিবন্ধনের সময় ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তবে বছরের অন্য সময়ও স্বাভাবিক নিয়মে নিবন্ধন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।’
এত কম সংখ্যক নারী নিবন্ধিত হয়েছে, তাহলে কী আপনাদের আহ্বানে সাড়া পড়েনি? জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ সচিব বলেন, ‘সাড়া পড়েনি এটি বলা ঠিক হবে না। আগে শুধু সৌদি আরবেই নারীরা যেত। গত প্রায় ৭ বছর সৌদিতে জনশক্তি রফতানি বন্ধ থাকলেও লেবানন, জর্ডান, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক নারী কর্মী গেছেন বা যাচ্ছেন। তাই হয়ত এখন কম সংখ্যক নারী নির্ধারিত সময়ে নিবন্ধিত হয়েছেন। কিন্তু, যখন সৌদিতে নারী কর্মী যাওয়া শুরু করবে তখন হয়ত অন্য নারী কর্মীরা আগ্রহী হবেন এবং নিবন্ধন করবেন।’
বেসরকারি জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বায়রা সভাপতি আবুল বাশার রবিবার রাতে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে কম সংখ্যক নারী নিবন্ধিত হয়েছেন-তা ঠিক। কিন্তু এটি তো চলমান থাকবে। সারা বছরই যে কেউ নিবন্ধন করতে পারবেন। এখনও তো সৌদি আরবে কর্মী পাঠানো শুরু হয়নি। যখন কর্মী পাঠানো শুরু হবে এবং সবাই যখন দেখবে যে তারা ওখানে ভাল আছে, তখন অন্যরা আগ্রহী হয়ে নিবন্ধন করবেন।’
গত ১০ ফেব্রুয়ারি মাত্র আটশ রিয়াল বেতনে বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী (নারী) নেওয়ার ব্যাপারে সৌদি সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি সই হয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ভবনে ‘এগ্রিমেন্ট অন ডমেস্টিক সার্ভিস ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক ওই চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার এবং সৌদি আরবের পক্ষে দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপমন্ত্রী ড. আহমদ আল ফাহাইদ স্বাক্ষর করেন।
চুক্তিতে স্বাক্ষর শেষে প্রবাসী কল্যাণ সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, চুক্তি অনুযায়ী গৃহস্থালি খাতে ১২টি ক্যাটাগরিতে সৌদি আরবে লোক যাবে। এরমধ্যে শুধু গৃহকর্মীদের (নারী) ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হয়েছে আটশ রিয়াল। কর্মীদের প্লেন ভাড়া, ভিসা ও ট্যাক্সসহ (লেভি) যাবতীয় খরচ বহন করবে নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া তাদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসার ব্যয়ও বহন করা হবে।
তিনি বলেন, ‘চুক্তি অনুয়ায়ী সৌদি আরবে এখন শুধু গৃহকর্মী (নারী) যাবে। পরবর্তীতে মালি, চালক, দারোয়ানসহ ১১টি পেশার লোক পর্যায়ক্রমে সৌদিতে যাবে।’
যদিও চুক্তি স্বাক্ষরের আগের দিন ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সফররত সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপমন্ত্রী ড. আহমদ আল ফাহাইদের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছিলেন, ‘সৌদি আরবে গৃহস্থালির (হাউজ হোল্ড ওয়ার্কার) কাজে প্রতি মাসে বিনা খরচে ১০ হাজার কর্মী যাবে। তাদের ন্যূনতম বেতন হবে ১৫শ রিয়াল। এর নিচে লোক পাঠাব না—এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর এ ঘোষণার পর রাজধানীর ইস্কাটনে সৌদি আরব যেতে আগ্রহীরা নিবন্ধনের জন্য ভিড় জমান। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গিয়েও ভিড় জমান এবং নিবন্ধনের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্যাভিলিয়ন ভেঙে ফেলেন। সৌদি আরব যেতে ইচ্ছুক মানুষের চাপ সামাল দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, পরবর্তীতে সৌদি সরকারের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্নের পর বিষয়টি মিডিয়ার কল্যাণে সবাই অবগত হন যে, সৌদি আরবে আপাতত শুধু নারী কর্মীরাই যাবেন এবং তাদের বেতন হবে ৮শ’ রিয়াল। যা বাংলাদেশী টাকায় সাড়ে ১৬ হাজার টাকার কিছুটা বেশি। এতে অনেকেই নিরুৎসাহিত হন বলে জানা গেছে।
সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশে গমনেচ্ছু নারী কর্মীদের নিবন্ধনের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিএমইটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার পাশাপাশি নানা প্রচারণা চালানো হয়।
প্রথম পর্যায়ে ৫ মার্চ থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা বিভাগ, ১২ থেকে ১৬ মার্চ রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ, ১৭ থেকে ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ এবং ২৪ থেকে ২৮ মার্চ খুলনা ও বরিশাল বিভাগে বিদেশ যেতে আগ্রহী নারীদের নিবন্ধন করার শিডিউল ঘোষণা করে মন্ত্রণালয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বিদেশ যেতে ইচ্ছুক নারী কর্মীদের বয়স হতে হবে ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের নগর ডিজিটাল সেন্টার এবং জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ে নিবন্ধন করা যাবে। প্রতি কর্মদিবসে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত নিবন্ধন চলবে। নিবন্ধনের জন্য ব্যয় হবে ৩০০ টাকা। এর মধ্যে সরকারি ফি ২০০ টাকা এবং ফরম পূরণে সহায়তার জন্য উদ্যোক্তাকে দিতে হবে ১০০ টাকা।
রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসমূহ হচ্ছে, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) বা জাতীয় পরিচয়পত্র, এ সব না থাকলে অবশ্যই জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র অবশ্যই আনতে হবে নিবন্ধন কেন্দ্রে। জন্ম নিবন্ধনে যে নাম ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে পরবর্তীতে হুবহু সেই তথ্যের ভিত্তিতে এমআরপি তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র (যদি থাকে) এক সেট ফটোকপি, প্রশিক্ষণের সনদপত্র (যদি থাকে), অভিজ্ঞতার সনদপত্র দেশে/বিদেশে) যদি থাকে এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান/পৌরসভা চেয়ারম্যান/সিটি করপোরেশন ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রদত্ত চারিত্রিক সনদপত্র।
সৌদি আরব বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার। দেশটিতে ২০ লাখের বেশী বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশী শ্রমিক নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল সৌদি আরব। গত ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করা হয়।