বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকার আশায় নিজের শেষ সম্বল বিক্রি করে দালালের হাত ধরে অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন বহু বাংলাদেশী। স্বপ্নের দেশে গিয়ে অনেকেই জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। কারণ প্রতিদিনই তাড়া করছে পুলিশ। বৈধ কোনো কাগজপত্র না থাকায় কেউ কেউ জঙ্গলে রাত্রিযাপন করছেন পুলিশের ভয়ে। অনেকে চাকরি করলেও ন্যায্য মজুরি পান না। রাজধানী কুয়ালালামপুর ছাড়াও কোতাবারু, পেনাং, জহুরবারু, ক্যামেরুন হাইল্যান্ড, ইপো, পেটালিং জায়া, শাহালমে কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের ভয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন পাহাড় ও জঙ্গলে। অবৈধ বলে নিয়োগকর্তাদের সব জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে তাদের। কথা বললে পুলিশের ভয় দেখিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। মালয়েশিয়ার উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতুক নূর জাজলান মোহামেদ বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৯ হাজার ২২২ জন অবৈধ বিদেশী শ্রমিককে আটক করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে ক্যামেরুন হাইল্যান্ডের একটি কনস্ট্রাকশন সাইডে দেখা মিলল ২০ জনের মতো বাংলাদেশী শ্রমিকের। সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের একজন বৈধ ছাড়া বাকি সবাই অবৈধ। তাদের মধ্যে মাছুম নামের এক শ্রমিক এ প্রতিবেদককে জানান, ২০১২ সালে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বৈধপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমান। কুয়ালালামপুরের শ্রি পেতালিং একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছেন এক বছর। এ সময় কম হলেও ১০ বার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। এখানকার পুলিশও দশ-বিশ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। তিনি আরও বলেন, ঝামেলা এড়াতে রাজধানীর মায়া ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে ক্যামেরুন হাইল্যান্ডে চলে আসি। এখানে কম বেতনের কাজ করলেও শান্তি ছিল। হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ক্যামেরুন হাইল্যান্ড। সেনাবাহিনীকে নিয়ে চিরুনি অভিযান চালায় সে দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ। একই বাগানে কাজ করা আমরা ১৪ জন টানা ৪ দিন পাহাড়ের গুহায় পালিয়েছিলাম। পরিস্থিতির অবনতি দেখে অনেকেই পাশের প্রদেশে পালিয়ে যান। উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, জানুয়ারি থেকে ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭১২ জন অবৈধ শ্রমিককে দেশে পাঠানোর জন্য জয়েন্ট ভলান্টারি ডেপোর্শন ত্রি-প্লাস ওয়ান প্রোগ্রাম করা হয়। ত্রি-প্লাস ওয়ান প্রোগ্রাম শুরু হয় ২০১৪ সালের ২২ জুলাই থেকে। ১৯ ডিসেম্বর ৪ লাখ ৫২ হাজার ৭৭৯ জন অবৈধ বিদেশী শ্রমিক তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে রাজি হয়েছেন। নূর জাজলান বলেন, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের রেকর্ড অনুযায়ী ১৮ লাখ ৫৬ হাজার ৮৬৯ জন বিদেশী শ্রমিক দেশটিতে বৈধভাবে কাজ করছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইমিগ্রেশন বিভাগ বিভিন্নভাবে নিশ্চিত করছে অবৈধভাবে কোনো বিদেশী যেন মালয়েশিয়াতে ঢুকতে না পারেন। তবে সরকারের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় এক বছর ধরে চলছে রি-হায়ারিং প্রোগ্রাম।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৫ ফেব্র“য়ারি থেকে এ সময় পর্যন্ত কতজন বাংলাদেশী নিবন্ধন করেছেন এ তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকাশ না করলেও স্থানীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এখনও ২২ লাখ অনিবন্ধিত বা অবৈধ শ্রমিক দেশটিতে বসবাস করছেন। যেসব অবৈধ বাংলাদেশী এখনও এ প্রকল্পের আওতায় আসেননি, তাদের দ্রুত নিবন্ধন করতে হবে। এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার প্রথমদিকে তেমন সাড়া না পেলেও চলমান সময়ে নিবন্ধন করার আগ্রহীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ কর্মীর প্রায় ৬৫ শতাংশ এখনও এ প্রকল্পের আওতায় আসেননি। যারা এখনও নিবন্ধন করেননি, তারা ৩১ ডিসেম্বরে মধ্যে অনলাইনে নিবন্ধন করে বৈধভাবে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করার আহ্বান জানিয়েছেন দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর সায়েদুল ইসলাম।
এদিকে মালয়েশিয়া সরকারের এ বৈধকরণ প্রক্রিয়ার ধীরগতির অভিযোগ তুলছেন এর আওতায় আসা কর্মীরা। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ সম্পন্ন করার পরও হাতে পাচ্ছেন না পাসপোর্ট। তবে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের সমস্যা নেই, সময় বেশি লাগলেও তারা পাসপোর্ট পাবেন।
ইমিগ্রেশন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, যারা পুনঃনিবন্ধনে অংশ নিচ্ছেন না এবং যে কোম্পানির মালিক অবৈধ শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ার ১৯৫৯/৬৩ অনুচ্ছেদের ৫৫(বি) ধারা মোতাবেক আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। অবৈধ শ্রমিক পাওয়া গেলে মালিকপক্ষ ও কর্মচারীকে ৫০ হাজার রিঙ্গিত জরিমানাসহ এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হবে। আইনে বলা হয়েছে, কোনো মালিকপক্ষ যদি পাঁচজনের বেশি অবৈধ শ্রমিক রাখে তাহলে ৫ বছরের জেল কার্যকর হবে। মালয়েশিয়ায় চলমান ‘অবৈধ’ বিদেশী শ্রমিকদের বৈধকরণ (রি-হায়ারিং) প্রকল্পে এ পর্যন্ত এক লাখ ৪০ হাজার বাংলাদেশী নিবন্ধন করেছেন। তবে এখনও বহুসংখ্যক বাংলাদেশী অবৈধ শ্রমিক বৈধতার জন্য আবেদন করেননি।