অভ্যন্তরীণ রুটে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ বহুদিনের। এক ঘণ্টারও কম সময়ের ফ্লাইটে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের বিমানভাড়া ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক রুটের সমান। তার পরও টানা অবরোধ-হরতালে বাড়তি বিমানভাড়া দিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে বাধ্য হয়েছে অনেকেই। সম্প্রতি সড়কপথে অচলাবস্থার সুযোগে ভাড়া বাড়িয়েছিল কয়েকটি বিমান কম্পানি। তবে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস একযোগে পাঁচটি রুটে ফ্লাইট চালু করায় এই মনোপলি ব্যবসার দিন শেষ হলো বলেই মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিমানভাড়া গ্রাহকদের হাতের নাগালে চলে আসায় অনেকেই বিমানে চড়তে উৎসাহিত হবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ব্যবসা আবারও চাঙ্গা হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, এত দিন অভ্যন্তরীণ রুটে ব্যবসা বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ ছিল না। টানা দুই বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং হরতাল-অবরোধে যাত্রীরা বিমানে যাতায়াত করতে অভ্যস্ততা বেড়েছে। যাত্রী বাড়ায় এখন অভ্যন্তরীণ রুটেও মনোযোগী হচ্ছে দেশীয় তিন বিমান সংস্থা। কয়েক বছর আগেও অভ্যন্তরীণ রুটে মাত্র লাখ দুয়েক মানুষ বিমানে চলাচল করলেও এখন শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সাত লাখ মানুষ বিমানে যাতায়াত করছে। প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ শতাংশ করে। এত দিন পুরো অভ্যন্তরীণ রুটে একচেটিয়া ব্যবসা করে আসছিল বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সূত্র জানায়, ফ্লাইট চালুর লক্ষ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ছয়টি অভ্যন্তরীণ রুটে টিকিট বিক্রি শুরু করে বিমান। এ জন্য ৭৪ আসনের অত্যাধুনিক দুটি ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ উড়োজাহাজও ইজিপ্ট এয়ার থেকে ইজারা নিয়েছে বিমান। গত শুক্রবার দুটি টার্বো প্রপ উড়োজাহাজ যুক্ত হয়েছে বিমানের বহরে। আজ সোমবার সকাল ৭টায় টার্বো প্রোপেলার উড়োজাহাজের প্রথম ফ্লাইট ঢাকা থেকে ছেড়ে যাবে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে।
বিমানের বিপণন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ রুটগুলোর মধ্যে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সপ্তাহে ছয়টি ফ্লাইট, ঢাকা-যশোর পাঁচটি, ঢাকা-রাজশাহী তিনটি এবং ঢাকা-সৈয়দপুর ও ঢাকা-বরিশালে দুটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করবে বিমান। ইতিমধ্যে এসব রুটে আগামী এক সপ্তাহের টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। এ ছাড়া আগামী এক মাসের বুকিংও শেষ।
জানা গেছে, বিমানের ভাড়া বেসরকারি এয়ারলাইনসের তুলনায় অনেক কম। বিমানের বিক্রয় বিভাগ জানায়, ওয়ানওয়ের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের ভাড়া চার হাজার টাকা। ঢাকা-কক্সবাজার পাঁচ হাজার ৫০০, ঢাকা-সিলেট তিন হাজার ২০০, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-সৈয়দপুর ও ঢাকা-যশোর ভাড়া তিন হাজার ৫০০, ঢাকা-বরিশাল তিন হাজার, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দুই হাজার ২০০ টাকা। সব ভাড়াই একবার ভ্রমণ এবং শুল্কসহ নির্ধারণ করা হয়েছে।
টানা তিন মাসের হরতাল-অবরোধে বিপর্যস্ত দেশের পর্যটন খাতের ক্রান্তিলগ্নে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমানের আগমনে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন পর্যটন খাতের উদ্যোক্তারা। সাধারণত শীতকাল পর্যটনের প্রধান মৌসুম। গত তিন বছর ধরে এ মৌসুমে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। শুধু চলতি মৌসুমেই পর্যটন খাতের ক্ষতি দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)। টোয়াবের পরিচালক এবং জার্নি প্লাসের প্রধান নির্বাহী তৌফিক রহমান গতকাল বলেন, ‘ঢাকা থেকে কক্সবাজারে সড়কপথে যেতে পর্যটকদের যে ধকল পোহাতে হয় তাতে কম খরচে বিমানে যেতে দেশি-বিদেশি পর্যটক আরো উৎসাহী হবে। বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর ভাড়া অনেক বেশি। ঢাকা-থেকে কক্সবাজারে রিটার্ন ভাড়া ১৫-১৬ হাজার টাকা দিয়ে নেপাল চলে যাওয়া যায়। বিমানের আরো আগে আসা উচিত ছিল। বিমান যে সময় অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চালু করছে তখন পর্যটন মৌসুম শেষ। ইতিমধ্যে কালবৈশাখী ঝড়, বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বিদেশিরা এই সময়টাতে বাংলাদেশে আসতে চায় না। বিমানের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক না। তারা যে কাজটা এখন করছে তা যদি সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে করত তাহলে বিমানের ব্যবসা আরো টেকসই হতো।
তৌফিক রহমান আরো বলেন, যেহেতু বিমান কম ভাড়ায় টিকিট বিক্রি করছে তাই টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু যখন স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে তখন মে-জুন মাসে গিয়ে বিমান বলবে লোকসান হচ্ছে। সিজন শেষ সুতরাং যাত্রী সংকট হবে এবং আগের মতো অভ্যন্তরীণ রুট ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক না বলে বিমান আবার ফ্লাইট বন্ধ করে দেবে- এটা যেন না হয়।
উড়োজাহাজ সংকট ও ক্রমাগত লোকসানের কারণে আড়াই বছর আগে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় বিমান। এই সুযোগে অভ্যন্তরীণ রুটে বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলো অব্যাহতভাবে ভাড়া বাড়িয়ে আসছিল।
যশোর-ঢাকা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, ইউএস বাংলা এবং নভো-এয়ার। যশোর থেকে ঢাকা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ন্যূনতম ভাড়া নিচ্ছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এই রুটে ইউনাইটেডের টিকিট মূল্য তিন হাজার ৮০০, চার হাজার ৪০০ এবং পাচ হাজার ৪০০ টাকা। ইউএস বাংলার ভাড়া চার হাজার ৪০০ থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। নভো-এয়ারের ভাড়া চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এই রুটে ভাড়া নির্ধারণ করেছে তিন হাজার ৫০০ টাকা।
তবে আকাশ পথে আকাশ ছোঁয়া ভাড়ার বিরুদ্ধে এক প্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অভ্যন্তরীণ রুট চালু উপলক্ষে ট্যাক্সসহ মাত্র ২৭০০ টাকা ভাড়া অফার করেছে। যদিও বিমানের এই বিশেষ অফারের টিকিট এপ্রিল মাসের মধ্যে কিনতে হবে এবং আগামী ১৫ থেকে ৩০ জুনের মধ্যে ভ্রমণ করতে হবে।