শাহজালালে ডিজিটাল দুর্নীতি: ৬শ কোটি টাকা প্রত্যাহারের হুমকি ডানিডার

Shajalal-Airportতাওহিদুল মাওলা, সিনিয়র রিপোর্টার, এভিয়েশন নিউজ: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের একটি প্রকল্পে ডিজিটাল দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে ইমেইলের মাধ্যমে কমিশন চেয়েছে একটি সিন্ডিকেট। এই অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ এনে সাড়ে ৫শ কোটি টাকার প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছে ডেনমার্কের সাহায্য দাতা সংস্থা ডানিডা। হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আপগ্রেডেশন অব শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট শীর্ষক প্রকল্পে তারা এই টাকা দিয়েছিল।

জানা গেছে, ডেনমার্ক সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের একটি প্রতিনিধি দল স¤প্রতি বাংলাদেশে এসে বেসামরিক বিমান চলাচলমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে দেখা করে এই হুমকি দেন। এর আগে এক মাসের মধ্যে প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যথাসময়ে চিঠির কোনো উত্তর না পেয়ে ওই প্রতনিধি দল ঢাকায় এসে ৩০ মার্চ মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে দেখা করে মধ্যে প্রকল্পে দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্য বন্ধ করতে ১ দিন সময় দেন এবং জানান, ব্যবস্থা না নিলে ডেনমার্ক সরকার এবং তাদের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিমানবন্দরের কাজ ফেলে দেশে ফিরে যাবে।

এ ঘটনায় মন্ত্রণালয় ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রকল্পটি নিয়ে একটি সিন্ডিকেট দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্য করতে চেয়েছিল। ই-মেইলে তারা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ঘুষ দাবি করেছিল। সেজন্য ডেনমার্ক ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকল্প থেকে তাদের অর্থায়ন প্রত্যাহারের হুমকি দিয়েছিল। মন্ত্রী জানান, এ ঘটনায় তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ায় ডেনিস প্রতিনিধি দল সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছে। দুর্নীতির ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার জন্যও তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান। মন্ত্রী বলেন, এখন প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, এর আগেও এই প্রকল্পটি নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছিল। সিন্ডিকেট তখন প্রকল্পের সর্বনিু দরদাতাকে কাজ না দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দাতা সংস্থা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এতে আপত্তি জানালেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। তখনও একবার ডানিডা এই প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন করবে না বলে সরকারকে চিঠি দিয়েছিল। বেবিচক নানা চেষ্টা-তদবির করে তাদের আবার ফিরিয়ে আনে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আবারও দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ক্ষুব্ধ হয় ডেনমার্ক ও তাদের সাহায্যদাতা সংস্থা ডানিডা।

ডানিডার একটি সূত্র জানায়, এবারের দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের বিষয়টি ছিল খুবই রহস্যজনক। এর সঙ্গে সরাসরি বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ আমলারা জড়িত থাকতে পারে বলে তার ধারণা। এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ই-মেইলে তাদের কাছে বার্তা আছে। ওইসব ই-মেইলে প্রকারান্তরে তাদের কাছে কমিশন দাবি করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ই-মেইলদাতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করায় মন্ত্রণালয় থেকে তাদের শোকজ পর্যন্ত করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, আপগ্রেডেশন অব শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নামের এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩১১ ডিকেকে অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। এ বিষয়ে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ও ডানিডার মধ্যে জিটুজি চুক্তি হয়। ২০১২ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ডেনিস ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাংক এসফল্টকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। কার্যাদেশ অনুযায়ী গত বছরের ২৪ ফেব্র“য়ারি মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়। কাজ বাস্তবায়নের শুরুতে ট্যাক্সিওয়ে পেভমেন্ট পুনর্র্নিমাণের জন্য ট্যাক্সিওয়েতে সয়েল (মাটি) টেস্ট করা হয়। ওই টেস্টে দেখা গেছে, ট্যাক্সিওয়ে পুনর্র্নিমাণ কাজের স্থলে প্রায় ১ থেকে ৪ ফুট কঁদা রয়েছে।

এই কাদা অপসারণ করতে হবে। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার পর দেখা গেছে কাদার পরিমাণ আরও বেশি। তাই অতিরিক্ত কাজ হিসেবে আরও ২৫ মিলিয়ন ডিকেকে অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা বেশি লাগবে। এরপর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ অনুযায়ী অতিরিক্ত কাজের মূল্য বাবদ ২৫ মিলিয়ন ডিকেকে অনুমোদনের জন্য ডানিডাকে জানানো হয়। ডানিডার একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে প্রকল্পটি সরেজমিন পরিদর্শন শেষে রিপোর্ট দেয়। ওই রিপোর্টের আলোকে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর ডানিডা অতিরিক্ত ২৫ মিলিয়ন ডিকেকে অন্তর্ভুক্তকরণের প্রস্তাব অনুমোদন করে। বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানোর পর গত বছর ১ নভেম্বর বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ও অতিরিক্ত ২৫ মিলিয়ন ডিকেকে অর্থ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় এবং বাস্তবায়নের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানায়।

কিন্তু হঠাৎ করে গত ১ ফেব্রুয়ারি এসএ রহিম নামে এক ব্যক্তি ই-মেইলে প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মাংক এসফল্টের সিইও মরিয়াস লরিডসেনের সাক্ষাৎ চায়। ই-মেইলে রহিম জানান, মন্ত্রণালয়র শীর্ষ কর্মকর্তাসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা তার পরিচিত। কাজেই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ না করলে প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ২৫ মিলিয়ন ডিকেকে অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫০ কোটি টাকার অনুমোদন বাতিল করে দেবে মন্ত্রণালয়। ই-মেইলে বলা হয়, ট্যাক্সিওয়ে পেভমেন্টের কাজ প্রকল্পের কার্যাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কাজেই বর্তমান দরেই তাদের এর কাজ সম্পন্ন করতে হবে। তাছাড়া বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। সিভিল এভিয়েশনের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাও এর বিরোধিতা করছেন।

ই-মেইল বার্তায় রহিমের ঠিকানা দেয়া হয় এসএ রহিম, ম্যানেজিং ডিরেক্টর চার্টার্ড কনসালটেন্স ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা sa-rahim—bangla.net এই ঠিকানা থেকে পাঠানো ই-মেইলে আরও বলা হয়, যদি তোমরা এই প্রস্তাবে রাজি থাক তাহলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষে অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকার বরাদ্দের বিষয়ে তিনি সহযোগিতা করবেন। মরিয়াস ই-মেইলটি পরদিন তাদের ঢাকা অফিসের কর্মকর্তা ময়ীনকে ফরোয়ার্ড করে বলেন, তিনি একটা আজগুবি মেইল পেয়েছেন। তুমি কি তাকে চেন? উত্তরে ময়ীন জানান, তিনি রহিম নামে কাউকে চেনেন না। রহিমের মেইলে মরিয়াস লিখলেন, প্রিয় রহিম, ধন্যবাদ মেইলের জন্য। কিন্তু আমি তোমাকে চিনি না। কাজেই তোমার সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এরপর রহিম দ্বিতীয়বার মেইলে জানান, ৫০ কোটি টাকা (২৫ মিলিয়ন ডিকেকে) অতিরিক্ত বরাদ্দের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর।

বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছাড়া এই টাকার অনুমোদন কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। তাছাড়া তোমার পকেট থেকে আমি কোনো কিছু নেব না। তুমি অতিরিক্ত বরাদ্দ থেকে যে এক্সট্রা লাভ করবে সেখান থেকে আমাকে দেবে। কাজেই দ্রুত তোমার সিদ্ধান্ত জানাও। কিছুদিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তুমি চাইলে আমাকে ফোন করতে পার। একই সঙ্গে তোমর ফোন নম্বরটিও আমাকে দাও। এবার ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান থেকে রহিমের মেইলের কোনো উত্তর না দিলে রহিম তৃতীয় মেইল করেন। সেখানে বলেন, আমি মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তির অনুমতি নিয়ে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এবং নির্দেশিত হয়ে জানাচ্ছি ব্যবসায়িক কাজে তোমার সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। দয়া করে বিষয়টি দ্রুত জানাও। কিন্তু এবারও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো উত্তর দেয়া হয়নি।

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, রহিম নামের ওই ব্যক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে ই-মেইলে তাদের এই চিঠি দিয়েছে। আর রহিমের এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ১৮ ফেব্র“য়ারি মন্ত্রণালয় থেকে সিভিল এভিয়েশনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়। শোকজ ও রহিমের মেইল দুটো বিষয় একই সূত্রে গাঁথা। শোকজ নোটিশে অহেতুক প্রকল্পটি সম্পর্কে তিনটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে বেবিচকের কাছে। এগুলো হল মাংক এসফল্ট, ডেনমার্কের সঙ্গে বিদ্যমান যে ঋণ চুক্তি আছে তার মধ্যে ট্যাক্সিওয়ে পেভমেন্ট কাজটি অন্তর্ভুক্ত আছে কিনা? যদি থাকে তাহলে ঠিকাদারকে এর বেশি অর্থ কেন দেয়া হবে। কাজের ডিজাইন ও ড্রয়িংয়ের আগে মাটি টেস্ট করা হয়েছিল কিনা? যদি সঠিকভাবে করা না হয়ে থাকে তাহলে সেজন্য দায়ী কে? তা চিহ্নিত করে জানানো হোক। সয়েল ইনভেস্টিগেশন সঠিকভাবে করা কি বেবিচকের দায়িত্ব ছিল? যদি দায়িত্ব হয়ে থাকে তাহলে বেবিচক কেন ভুল পরীক্ষার জন্য দায়ী ঠিকাদারকে এই বিশাল পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ দেবে।

মন্ত্রণালয়ের সহকারী প্রধান জিনাত মহল স্বাক্ষরিত নোটিশে জরুরি ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। কিন্তু বেবিচকের এক বিশেষজ্ঞ জানান, মূলত রহিম নামের ওই ব্যক্তির সঙ্গে কমিশন বাণিজ্য সংক্রান্ত নেগোসিয়েশনে না যাওয়ায় মন্ত্রণালয় এই ব্যাখ্যা দিয়েছে। তিনি বলেন, এর সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ ব্যক্তি সচিব পর্যন্ত জড়িত থাকতে পারে! কারণ সচিবের অনুমতি ছাড়া একবার অনুমোদন দিয়ে দ্বিতীয় দফায় ওই বিষয়ে আবার ব্যাখ্যা তলব করার সাহস অন্য কোনো কর্মকর্তার হবে না। অপরদিকে রহিম নামে ওই ব্যক্তি মেইলে যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছিল মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার সঙ্গে তার হুবহু মিল রয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে ইমেইলে কমিশন দাবিকারী রহিম মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তির যোগসাজশে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে মেইলটি করেছিল। আর তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় এই শোকজ লেটারটি দেয়া হয়।

কারসাজি :
এ বিষয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এ ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তার মতে, এটা ডানিডা কিংবা বেবিচকের কারসাজিও হতে পারে। ২৫ মিলিয়ন ডিকেকে জায়েজ করার জন্য এ ধরনের ই-মেইল নাটক তৈরি করতে পারে কেউ। তিনি বলেন, ডানিডাকে কেউ যদি ই-মেইলে হুমকি দিয়ে থাকে সেটা তারা মন্ত্রণালয়কে জানালো না কেন? মন্ত্রণালয় এখনও ২৫ মিলিয়ন ডিকেকে দেয়ার বিপক্ষে। তবে তিনি স্বীকার করেন, পুরো বিষয়টি রহস্যজনক। এ বিষয়ে বেবিচকের একজন প্রকৌশলী জানান, মন্ত্রণালয় যে কোনো কারণে হোক ১৮ ফেব্রুয়ারি তাদের কাছে একটি ব্যাখ্যা তলব করেছিল। ব্যাখ্যার জবাবও তারা দিয়েছেন। তবে ই-মেইলে কেউ কোনো হুমকি দিয়েছিল কিনা বা ঘুষ চেয়েছিল কিনা তা তার জানা নেই।

– তাওহিদুল মাওলা

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.