তারফিয়া ফয়জুল্লাহ। শিকড় বাংলাদেশে। থাকেন আটলান্টিকের ওপারে, মার্কিন মুলুকে। অনেক বাংলাদেশির মতো তিনিও ভোলেননি তার শিকড়, ভুলতে পারেননি অথবা চাননি। তবে অনেকের মধ্যে তার বিশেষত্ব হলো_৩৫ বছর বয়সী এই নারী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গবেষণা করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ঘুরে একাত্তরের বীরাঙ্গনা নারীদের সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধদিনের দুঃসহ দুঃখ-স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন কাব্যগাথা। ‘সিম’ নামে প্রকাশিত সেই কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন পুরস্কারও। তাকে নিয়ে লিখেছেন আলমগীর খন্দকার
তারফিয়ার মা-বাবা ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। এর দু’বছর পর ১৯৮০ সালে নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত ব্রুকলিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন তারফিয়া। বেড়ে উঠেছেন টেক্সাসে। ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। ছোটবেলা থেকেই গান ও কবিতা লেখেন তারফিয়া। ইদানীং গদ্যও লিখছেন। দি আমেরিকান পোয়েট্রি রিভিউ, দ্য মিসৌরি রিভিউ, নাইন্থ লেটার, ব্ল্যাকবার্ড, দ্য ম্যাসাচুসেটস রিভিউ, দ্য সাউদার্ন রিভিউ, মেমোরিয়ার্সসহ বিভিন্ন সাময়িকীতে তার কবিতা ছাপা হয়েছে।
বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন তারফিয়া। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার বীরাঙ্গনাদের নিয়ে গবেষণা করতে ২০১০ সালে তিনি ফেলো হিসেবে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে বাংলাদেশে আসেন।
বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বলে রচনা করেন সাক্ষাৎকারভিত্তিক কাব্যগ্রন্থ ‘সিম’। সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে গত বছরের মার্চে ৮০ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশিত হয়। বইটি জিতে নেয় ক্র্যাব অরচার্ড সিরিজ ইন পোয়েট্রি পুরস্কার। সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি প্রেস ও বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের ষাণ্মাসিক প্রকাশনা ‘ক্র্যাব অরচার্ড রিভিউ’ প্রতি বছর দু’জন কবিকে এ পুরস্কার দিয়ে থাকে। এর পুরস্কার মূল্যমান সাড়ে তিন হাজার ডলার। এর আগে ২০০৯ সালে তারফিয়া কবিতার জন্য পেয়েছেন কোহেন অ্যাওয়ার্ড। ছোটগল্প ও কবিতায় এই পুরস্কার দিয়ে থাকে মার্কিন সাহিত্য ম্যাগাজিন প্লাউশেয়ারস।
সিম : বীরাঙ্গনাদের দুঃখগাথা
‘মাটির নিচটুকুই শুধু জেনেছি : শরীর গাদা করা শরীরের ওপর
গোঙানি, ঘাম, পচন খুঁজে নিচ্ছে আমাদের ঊরুসন্ধি, আর
পিঠের যেখানটায় অস্থায়ী উল্কি খুদে সে আমাদের চিহ্নিত করেছিল।
দুধ-চা আর মাখন লাগানো বিস্কুট খেতে খেতে সেনাপতি জানতে চেয়েছে আমাদের শিরার ভেতরে নোংরা রক্ত নিয়ে চলতে কেমন লাগে।…’ (সিম থেকে অনুবাদ কৃতজ্ঞতা : লুনা রুশদি)
ইংরেজি ‘সিম (ঝবধস)’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হতে পারে_ স্তর, দুই টুকরো কাপড়ের জোড়ের মুখের সেলাই, মাটির নিচে মূল্যবান আকরিকের স্তর ইত্যাদি। তারফিয়ার কবিতায় ঘুরেফিরে এসেছে সিম শব্দটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর নির্যাতনে ২ লাখ নারী সম্ভ্রম হারান। স্বাধীনতার পর সদ্য গঠিত বাংলাদেশ সরকার ওই নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব দেন।
স্বাধীনতার পর এসব নারীর দিন এখন কীভাবে কাটে_ তা জানতে বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে এক বছর ছুটে বেড়ান তারফিয়া। যুদ্ধদিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি নিয়ে কী ভাবেন ওই নারীরা_ জানতে চেয়েছেন। দুঃসহ সেই সব দিনের স্মৃতি তাদের মুখে শুনে তা মলাটবন্দি করতে চেয়েছেন তারফিয়া। পরম মমতায় সেই সব দুঃখ-স্মৃতি কবিতার নরম-কঠিন শব্দে তুলে ধরেছেন তিনি ‘সিম’ নামের কাব্যগ্রন্থে। তারফিয়া বলেন, সিম এমন একটা বই, যা তার আখ্যান ও গঠনে নির্ভর করেছে দূরত্বের ওপর_ দুই মহাদেশের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দূরত্ব আবার স্বাধীনতার বছরের বাংলাদেশ এবং আধুনিক বাংলাদেশের মধ্যকার দূরত্ব।
কীভাবে কাজ?
প্যারিস রিভিউ নামে একটি সাহিত্য সাময়িকীতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তারফিয়া বলেন, ২০০৬ সালে বাংলাদেশি লেখিকা শাহীন আখতারের ‘তালাশ’ উপন্যাসের একটি ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে প্রথম জানতে পাই। তখনই এ বিষয়ে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে যে ভয়াবহ নৃশংসতা চালানো হয়েছিল আগে তা জানতামই না। দিনের পর দিন নারীদের বন্দি রেখে তাদের ওপর কী যে দুর্বিষহ যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছিল_ তা কল্পনা করতে পারছিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, এ নিয়ে বড় আকারে কাজ করব। নির্যাতনের শিকার ওই নারীদের কথা তুলে ধরব বিশ্ব পরিসরে। সেই চিন্তা থেকেই বৃত্তি নিয়ে চলে গেলাম ঢাকায়।
তারফিয়া সিরাজগঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান চষে বেড়ান। বিভিন্ন এলাকার যুদ্ধদিনের ‘বীরাঙ্গনা ও বিধবা পল্লী’তে গিয়ে তাদের সাক্ষাৎকার নেন। মনোযোগ দিয়ে শোনেন তাদের কষ্টকথা। তারফিয়া জানান, তার এ কাজে বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরীও তাকে সহযোগিতা করেন। তিনি তার যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতা শোনান। সাফিনা লোহানি নামে অপর এক নারী মুক্তিযোদ্ধাও তাকে ব্যাপক সহযোগিতা করেন। সাফিনা সিরাজগঞ্জে বীরাঙ্গনাদের উন্নয়নে একটি প্রতিষ্ঠানও চালান। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বীরাঙ্গনাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেন তারফিয়াকে। তারফিয়া বলেন, সে সময় কথা বলছিলাম একই পরিবারের কয়েক বোনের সঙ্গে। তারা সবাই বীরাঙ্গনা। কথা বলার সময় এক বোন পেছনে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। বলেন, আহারে, তোমার চুল আঁচড়িয়ে দেওয়ার কেউ নেই, না? আমি এ আচরণে মুগ্ধ হয়ে যাই। সে সময় এমন এক বাংলাদেশ আবিষ্কার করলাম, যার অস্তিত্ব অজানা ছিল আমার কাছে, যা একই সঙ্গে খুব জটিল ও সুন্দর।
কবিতা : এক প্রাচীন প্ররোচনা
ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখেন, গান ভালোবাসেন তারফিয়া। তার কাছে কবিতা হলো সুর ও শব্দের প্রতি অনুরাগের যোগসূত্র। তারফিয়া বলেন, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কবিতা এক প্রাচীন প্ররোচনা। কবিতা প্রথমত ছিল মৌখিক, এখন লেখা হয়। কবিতা আমাদের সবচেয়ে মানবিক অংশটুকুতে টোকা দেয় শব্দ ও সঙ্গীত ব্যবহার করে অর্থ সৃষ্টির মাধ্যমে। তারফিয়ার রয়েছে একজন বাংলাদেশি-মার্কিন হিসেবে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা। বীরাঙ্গনাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বিদেশে বড় হওয়া একজন বাঙালি মেয়ের অভিজ্ঞতার তুলনা করেছেন লেখায়। তার বইটিতে একই সঙ্গে এসেছে বীরাঙ্গনাদের কথা, সাক্ষাৎকার গ্রহীতার অভিজ্ঞতা এবং অনুভব।