নানা বিধিনিষেধের কারণে সৌদি নারীরা বহু বছর ধরেই ঘরের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। বেছে নিতে পারেন না মনের মতো কোনো পেশা। প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের সময় কিছু ক্ষেত্রে শিথিলতা আনায় মেয়েদের ঘরের বাইরে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য মিলেছে। শেষের দিকে তিনি নারীদের সীমিত আকারে প্রশাসনিক পদে কাজ করারও সুযোগ দেন। সৌদি নারী এখন আইনজীবী হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন। এরপরও তাঁরা পুরোমাত্রায় পুরুষ অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে বাঁধা। নারীর এখনো মেলেনি গাড়ি চালানোর সুযোগ।
আরবের আইন অনুযায়ী দেশটির সব নারী ও শিশুর অবশ্যই একজন করে পুরুষ অভিভাবক থাকতে হবে। হতে পারেন তিনি বাবা, ভাই, স্বামী বা ছেলে। নারীকে ঘরের বাইরে যেতে, কাজে যেতে, বিয়ে করতে, বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাতে-এমনকি ব্যাংক হিসাব খুলতে সেই পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নিতে হয়।
অথচ সৌদি আরবের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের প্রায় ৬০ শতাংশ নারী। তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ চাকরি করেন। কঠোর আইন ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা সৌদি নারী সেভাবে কর্মজীবী হয়ে উঠতে পারেননি। তবে ধীরে ধীরে এ চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে।
সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১০ সালে বেসরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার। ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়ায় চার লাখ ৫৪ হাজারে।
তা সম্ভব হয়েছে প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের নেওয়া এক ঝাঁক সংস্কার কর্মকাণ্ডের অংশ ও নারীদের পরিচালিত প্রচারের কারণে। বাদশাহ তাঁর শাসনকালের শেষ দিকে পরামর্শক পরিষদ সুরা কাউন্সিলে একজন নারীকে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন এবং নারীরা যে ধরনের কাজ করতে সক্ষম, সেগুলোর ওপর থেকে বিধিনিষেধ শিথিল করেন।
এখন সৌদি নারীদের জন্য ব্যবসা কেন্দ্রে ও সেবা খাতে চাকরি করার অনুমতি রয়েছে। ২০১৩ সালের শেষ দিকে সৌদি নারী আইনজীবীরা প্রথমবারের মতো পেশাগতভাবে চর্চা করার অনুমতি পান। এখন কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীদের নিয়োগ দিচ্ছে রাষ্ট্র। এখন নারীরা সেখানে পত্রিকার সম্পাদক ও টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানের উপস্থাপকও হচ্ছেন।
লন্ডনভিত্তিক সৌদি রাষ্ট্রায়ত্ত আরবি পত্রিকা আশারকুয়ালাউয়াস্ত-এর ফিচার সম্পাদক আবের মিশকাজ বলেন, দোকানে নারীদের কাজ করার বিষয়টি বহির্বিশ্বের কাছে তুচ্ছ মনে হতে পারে। কিন্তু সৌদি আরবের জন্য এটি উল্লেখযোগ্য একটি অগ্রগতি। তিনি বলেন, যতটা অগ্রগতি হওয়া উচিত ছিল, ততটা না হলেও ধীরে ধীরে হচ্ছে। গত ১০ বছরের হিসেব করলে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেছে। এখন নারীদের জন্য অনেক কর্মসংস্থান ও খাত তৈরি হয়েছে, যা তাঁরা কোনো দিন স্বপ্নেও দেখেননি।
সৌদি আরবে, বিশেষ করে নারীদের জন্য ২০১৩ সালে প্রথম রিক্রুটিং এজেন্সি গ্লোওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদ আলখুদাইর বলেন, নারীরা যতই যোগ্যতা সম্পন্ন হোন এবং কাজ করতে আগ্রহী হন না কেন, তাঁদের কর্মস্থল সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু নারীর পরিবারের পুরুষদের বাইরে অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার অভিজ্ঞতাই নেই।
২৩ বছর বয়সী আলফা আলগিদ এ বছর কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। গ্লোওয়ার্ক-এর মাধ্যমে তিনি ডেনমার্কের দূতাবাসে দোভাষীর চাকরি পেয়েছেন। সম্ভবত তিনি দেশটিতে ইউরোপীয় কোনো দূতাবাসে প্রথম সৌদি নারী কর্মী। আলগিদ বলেন, ‘আমি সব সময় কাজ করতে চেয়েছি। স্নাতক পাস করার পর এটি আমার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল। আমি যেন স্বাধীনতা পাই এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, সে চেষ্টা ছিল সব সময়। অনেক নারী আছেন, যাঁরা অন্য পুরুষদের সঙ্গে পরিচিত হতে পছন্দ করেন না। কিন্তু আমি এ বিষয়টিকে কাজের অংশ বলে মনে করি।’
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো প্রচলিত ক্ষেত্রগুলোর বাইরে কাজ করতে গেলে নারীদের অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়। আলখুদাইর বলেন, যারা সৌদি নারীদের কাজ করা পছন্দ করেন না, তারা তাঁর কোম্পানিতে অনেক অভিযোগ পাঠিয়েছেন ও হুমকি দিয়েছেন।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের সহযোগী অধ্যাপক স্টিফেন হারতগ বলেন, নারীদের কাজ করার ক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থা একটি বিশাল ব্যাপার। তিনি বলেন, যেসব নারীর পরিবারে গাড়ি রয়েছে, তাদের হয়তো চালক আছে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠান পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে। কিন্তু এমনটাই হতে হবে, এমন কথা নেই। এটি করতে গেলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি অর্থ গুনতে হয়। গাড়ি চালাতে না দেওয়া নারীদের কর্মজীবী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা।
পরিবারের রক্ষণশীল মূল্যবোধে যেন আঘাত না লাগে, এ জন্য শুধু নারীদের জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। যেমন ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে রিয়াদের আকারিয়া জেলায় একটি নতুন ব্যবসা প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র ৫০০ নারীকে নিয়োগ দিয়েছে। তাদের লক্ষ্য তিন হাজার নারীকে নিয়োগ দেওয়া। প্রতিষ্ঠানটি তার গ্রাহকদের অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদ সেবা দিয়ে থাকে।
সৌদি আরবের শ্রম সংস্কারের বিশেষজ্ঞ স্টিফেন হারতগ বলেন, জরিপে দেখা গেছে, যৌন হয়রানি ও পরিবারের অপছন্দের কারণে অনেক নারী শুধু নারীরা আছেন-এমন কর্মস্থলে কাজ করতে চান। এমন ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয়। কারণ তাঁদের জন্য আলাদা প্রবেশপথ ও স্নানাগার তৈরি করতে হয়। লাগে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা।
অনেকেই এই নারী-পুরুষের বিভাজনের সমালোচনা করেছেন। তাঁরা মনে করেন, এতে সৌদি সমাজে আরও বিভাজন তৈরি হবে। যা দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখবে না। তবে কোম্পানি মালিকেরা এর সঙ্গে একমত নন।
প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেনারেল ইলেকট্রিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হাশিম আল বখাইল বলেন, এটি বিভাজনের বিষয় নয়। সুন্দর কর্মপরিবেশের মধ্য দিয়ে নারীদের কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করাই হচ্ছে প্রধান বিষয়। বিবিসি ক্যাপিটাল অবলম্বনে