যুক্তরাষ্ট্র অফিস : বর্ণিল আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বরণ করে নিলেন বাংলা নতুন বছর ১৪২২-কে। এ উপলক্ষে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দিনব্যাপী উৎসবে মেতে ছিলেন নানান বয়সের মানুষেরা। পান্তা ইলিশ পরিবেশন এবং বাঙালী সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে চলে বর্ষবরণের এই উৎসব।
নিউইয়র্কের বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের প্রাণকেন্দ্র জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জেবিবিএ এনওয়াই। ঢাকা থেকে আসা ও স্থানীয় শিল্পীরা বৈশাখের গানে গানে মাতিয়ে তোলেন পুরো এলাকা।
জেবিজিএ’র সভাপতি মহসীন মিয়ার সভাপতিত্বে ও মোশাররফ হোসেনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কন্স্যুলেটের কন্সাল জেনারেল শামীম আহসান। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেবিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক আবুল ফজল দিদারুল ইসলাম, জেবিবিএ’র সাবেক সভাপতি সৈয়দ রহমান মান্নান, জেবিবিএ’র কর্মকর্তা রাশেদ আহমেদ, রফিক আহমেদ, আমিনুর রশিদ বাদশা, সফিকুল ইসলাম, গিয়াস মজুমদারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কন্সাল জেনারেল শামীম আহসান সবাইকে বাংলা নব বর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, জ্যাকসন বাংলাদেশী বিজনেস এসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা শুধু বাংলাদেশের পণ্যই তুলে ধরছেন না, তারা বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকেও তুলে ধরছেন। তিনি আরো বলেন, ভিন্ন একটি দেশের মাটিতে বাংলাদেশের জয়গান তুলে ধরা এবং নিজেদের সংস্কৃতিকে অন্য সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত করার অনেক বড় বিষয়। তিনি বলেন, আপনারা শুধু বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন না, আপনারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও বিরাট ভূমিকা রাখছেন। আপনাদের কথা বুঝা যাচ্ছে আপনারা প্রতিনিয়ত দেশের খবরা খবর রাখছেন। আমরা আশা করি নতুন বছর আমাদের জীবনে নতুন শান্তির বারতা নিয়ে আসবে।
জেবিবিএ’র সভাপতি মহসীন মিয়া সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, আমাদের দেশে যেন শান্তি ফিরে আসে। মানুষ যেন নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে।
সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে প্রায় ৫ শতাধিক লোকের মধ্যে ফ্রি পান্তা- ইলিশ ও বিভিন্ন ধরনের ভর্তা বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠান শুরুর প্রক্কালে লোকজনের উপস্থিত একটু কম হলেও পান্তা- ইলিশ বিতরণের পর থেকেই ডাইভার সিটি প্লাজায় বাঙালি পোশাকে নরনারীদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। বাঙালি পোশাক- আশাক এবং উৎসবের মধ্যে বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে পারে তারই প্রমাণ পাওয়া গেল জেবিবিএ’র অনুষ্ঠানে। লোকজনের উপস্থিতিতে ডাইভার সিটি প্লাজায় এবং আশেপাশের এলাকায় লোকাজন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের বাঙালি পোশাকে প্রমাণ করেছে প্রবাসেও বাঙালিয়ানা হারিয়ে যাবে না।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বহ্নিশিখা সঙ্গীত নিকেতনের শিল্পীরা, কবির বকুল, জিনাত জাহান মুন্নী, সবিতা দাস, রূপা আলমগীর, মনিকা দাস, শাহ মাহবুবুসহ প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। নতুন বছরে যে বাঙালি শাড়ি এবং পাঞ্জাবী- পায়জামায় অপরূপ তারই নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেল ডাইভার সিটি প্লাজায় জেবিবিএ’র আয়োজনে। নতুন বছরে নতুন বছরে যারা সেজেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই ছবি তুলে তা ফেইসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। গান এবং আনন্দ উল্লাসে সন্ধ্যায় শেষ হয় জেবিবিএ’র বর্ষবরণ ১৪২২। অনুষ্ঠানকে সফল এবং স্বার্থক করার জন্য জেবিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক আবুল ফজল দিদারুল ইসলাম সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
প্রতিবছরের মত বাংলা নববর্ষকে জাঁকজমকভাবে বরণ করে নিউইয়র্কের সাংস্কৃতিক সংগঠন ড্রামা সার্কল। প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত অ্যাস্টোরিয়ার সাউন্ডভিউ মিলনায়তনে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলা এ অনুষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি অংশ নেন। তাদের উপস্থিতিতে পুরো অনুষ্ঠান পরিণত হয় বাংলাদেশিদের মিলনমেলায়। অনুষ্ঠানে গান, আবৃত্তি ও নাচ ছাড়াও অতিথিদের পান্তা ইলিশ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান, সাবেক এমপি এমএম শাহীন, ড্রামা সার্কলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নার্গিস আহমেদ, নিউইয়র্ক সিটির সাবেক কম্পট্রোলার জন ল্যু, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ডা. দেলোয়ার হোসেন, ড. মাহফুজ আর চৌধুরী। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ড্রামা সার্কলের সভাপতি আবীর আলমগীর।
এদিকে উডসাইডের কুইন্স প্যালেসে জমজমাট বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ সোসাইটি। অনুষ্ঠানে শত শত প্রবাসী বাংলাদেশি সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নানান অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। অনুষ্ঠানে অতিথিদের মাছে পান্তা ইলিশ পরিবেশন করা হয়।
শান্তির পায়না ও বেলুন উড়ান সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীর, বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আজমল হোসেন কুনু, সাবেক সভাপতি এম আজিজ, কামাল আহমেদ, বাংলাদেশ সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রানা ফেরদৌস চৌধুরী, সাবেক সহ সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট অভিনেতা আহমেদ শরিফ, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আলাউদ্দিন ভুলু, সাবেক সদস্য আলী ইমান শিকদার, বাংলাদেশ সোসাইটির বর্তমান কার্যকরী কমিটির সদস্য মহিউদ্দিন দেওয়ান, ফারুক হোসেন মজুমদার, ওসমান চৌধুরী, মোহাম্মদ আলী, এ কে এম জামান, মনিকা রায়, কাজী তোফায়েল, সৈয়দ এনায়েত আলী, মফিজুল ইসলাম রুমি, কাজী ওয়াহিদ এলিন, ফারহানা চৌধুরী, এ কে এম রফিকুল ইসলাম ডালিম, নাদের এ আইয়ুব, সিরাজুল হক জামাল, আবুল কাশেম চৌধুরী, নাসির উদ্দিন আহমেদ, কম্যুনিটি লীড়ার খন্দকার ফরহাদ, কাজী নয়ন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম হাওলাদার।
আজমল হোসেন কুনুর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, কনসাল জেনারেল শামীম আহসান, সাবেক সভাপতি এম আজিজ, সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদ, মহিউদ্দিন দেওয়ান, ফারুক হোসেন মজুমদার, ওসমান চৌধুরী, কাজী তোফায়েল ইসলাম প্রমুখ।
আলমগীর কবির বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, নতুনকে সবসময় স্থান করে দিতে হয়। নতুনই হচ্ছে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যত। আজকে এই সুন্দর অনুষ্ঠানে আমি বাংলাদেশকে দেখতে পাচ্ছি। আমরা যারা বাংলাদেশী তারা বিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। আমাদের সংস্কৃতি প্রায় সাড়ে ৬ হাজার বছরের সংস্কৃতি। আমেরিকার সংস্কৃতি কত দিনের। আমাদের সংস্কৃতি হচ্ছে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রীস্টানদের নিয়ে ঐক্যের সংস্কৃতি। আমাদের ভালবাসার দেশ বাংলাদেশ, উদারতার দেশ বাংলাদেশ, প্রবাসীদের ভরসার দেশ বাংলাদেশ, সংস্কৃতির দেশ বাংলাদেশ। তিনি আরো বলেন, পয়লা বৈশাখের পান্তা ইলিশের সংস্কৃতি এখন আর নেই। আমাদের দেশের কৃষক, গার্মেন্টস শ্রমিক এবং প্রবাসীদের পরিশ্রমের পান্তা ইলিশ এখন অভিজাত গুলশানে, বারিধারায় এবং ডিওএইচএসে। আর এবার দেখতে পাচ্ছি নিউইয়র্কে। তিনি আরো বলেন, আমাদের গ্রামের অর্থনীতি জেগে উঠেছে, জীবনবোধ জেগে উঠেছে, ভালবাসা জেগে উঠেছেÑ তাতে করে নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। এত কিছুর মধ্যেও আমাদের কিছু সমস্যা আছে। আর সেই সমস্যা দূর করতে প্রয়োজন ঐক্য। আপনাদেরকে যেভাবে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ দেখেছি, একইভাবে বাংলাদেশেও আমাদের সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশ দাঁড়াবে।
অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয় প্রবাসে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোরদের মধ্যে বিষয়ভিত্তিক প্রতিযেগিতার মাধ্যমে। প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপিকা হুসনে আরা, কবি ফকির ইলিয়াস, তমিজ উদ্দিন লোদী, সিরাজউদ্দিন আহমেদ সোহাগ ও কাজী ওয়াহিদ এলিন। অনুষ্ঠানে বিজয়ী কৃতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পুরস্কার করা হয়। অতিথিবৃন্দ বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেন। এ ছাড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে তাদের সবাইকে শান্ত¦না পুরস্কার দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মনিকা রায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি, ও পুথিপাঠ করেন প্রবাসের জনপ্রিয় শিল্পী, কবিবৃন্দ।