সিন্ডিকেটের কবলে সৌদিয়ার টিকিট: হাজীদের ভোগান্তি এবারও!

saudia-airlinesএভিয়েশন নিউজ: বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোতে টিকিট ওভার বুকিংয়ের নামে চলছে ভয়াবহ প্রতারণা। এর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি জড়িত সাউদিয়া এয়ারলাইন্স।

অভিযোগ এয়ারলাইন্স সংস্থার এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং হজ ও ওমরা কো-র্ডিনেটর লাবনী হাসনা চৌধুরী নেতৃত্বে ৭/৮টি ট্রাভেল এজেন্সির সিন্ডিকেট এই প্রতারনা করছে। তারা সাউদিয়া থেকে টিকিট ক্রয় করে সেই টিকিট মোটা অংকের টাকায় বিক্রি করছে। এছাড়া টিকিট বিক্রি করেও যাত্রীদের যথাসময়ে ওমরায় পাঠাচ্ছে না।

নানা কৌশলে দিনের পর দিন বিমান বন্দরে আটকে থাকতে হচ্ছে ওইসব ওমরা হজ যাত্রীদের। শ্রমিক কর্মচারীদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। এদের কাছ থেকে টিকিটের টাকা নিলেও যথা সময়ে তাদের গন্তব্যে পাঠাচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী ফ্লাইট ছাড়তে ৮ ঘন্টা দেরী হলে যাত্রীদের হোটেলে দিতে হয়।

কিন্তু সাউদিয়া কতৃপক্ষ সেটাও করছে না। এতে শত শত মানুষ বিমান বন্দরে এসে না খেয়ে না ঘুমিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। অনুসন্ধানে জানাগেছে সাউদিয়া এয়ারলাইন্স এবারের ওমরা হজ চলাকালীন সময়ে নানা অপকৌশল ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ‘ওভার বুকিং’ দিয়ে হাজার হাজার যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করছেন।

তাদের বক্তব্য বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরিন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ওভার বুকিং দিয়ে এক দিকে যাত্রী হয়রানি করছে, অপর দিকে রাস্ট্রায়াত্ব ক্যারিয়ার বিমানের যাত্রীও কেড়ে নিচ্ছে। এই বিষয়ে সরকার ও বেসামরিক বিমান চলাচল কতৃপক্ষ কোন ব্যবস্থাও নিচ্ছে না। এতে পার পেয়ে যাচ্ছে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে ওভার বুকিং দিয়ে বিদেশী এয়ারলাইন্সের নিজস্ব অভ্যন্তরিন সিন্ডিকেট প্রতিমাসে ১শ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে।এই তালিকায় এখন শীর্ষে আছে সাউদিয়া এয়ারলাইন্স, টার্কিস এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ, কুয়েত এয়ারলাইন্স, এমিরাটস এয়ারলাইন্স।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সুত্রে জানাগেছে শুধুমাত্র সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের অবৈধ ওভার বুকিংয়ের কারণে গত এক মাসে ৫শর বেশি যাত্রী যথাসময়ে তাদের গন্তব্যে পৌছতে পারেননি। শুধু সাধারণ যাত্রীই নয়, কিছুদিন আগে এই ওভার বুকিংয়ে শিকার হয়ে একটি ফ্লাইটে ২৪ জন ওমরা হজ যাত্রী সৌদি আরব যেতে পারেননি যথাসময়ে। টিকিটসহ সব আনুসঙ্গীক কাগজপত্র থাকলেও বিমান বন্দর থেকে তাদের বাসায় ফেরত যেতে হয়েছে।

এছাড়া প্রতিদিন টিকিট থাকলেও গড়ে ২০/২৫জন শ্রমিক শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর যাত্রীদের নানা কৌশলে ফ্লাইট দেয়া হচ্ছে না। অথচ অন্যদিকে বিমান আসন খালি নিয়ে ফ্লাইট ছাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে এই অবৈধ ওভার বুকিংয়ে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সকে সহযোগিতা করছে ৭টি ট্রাভেল এজেন্ট। এগুলো হল সঞ্চারী ট্রাভেল, ভার্সেটাইল, মুনা ট্রাভেল, ডাইনেস্টি ট্রাভেল গোল্ডেন বেঙ্গল ট্রাভেল, এয়ার ট্রিপ, কাজী এয়ার, সুরেশ্বর। এসব ট্রাভেল এজন্সিগুলোর নেতৃত্বে আছেন ভার্সেটাইলের স্বপন চৌধুরী।

অভিযোগ রয়েছে, সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের হজ ও ওমরা ফ্লাইট সমন্বয়কারী লাবনী হাসনা চৌধুরীর যোগসাজসে এই সিন্ডিকেট টিকিট নিয়ে সাধারণ ও নিরীহ হজ ও ওমরা যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করছে। সিন্ডিকেট যাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে প্রতিদিন গড়ে তাদের ধারন ক্ষমতার চেয়ে ২/৩শ বেশি যাত্রী ও ওমরা হজ যাত্রীর কাছে কর্ণফার্ম টিকিট বিক্রি করছে। কিন্তু বিমান বন্দরে গিয়ে যাত্রীরা জানতে পারছেন তাদের ফ্লাইট নেই। জানাগেছে নানা কৌশলে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে এসব যাত্রীদের যথাসময়ে ফ্লাইট দেয়া হচ্ছে না।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাজীদের জন্য থার্ড ক্যারিয়ার উন্মুক্ত করার ব্যাপারে আদেশ দেয়ার পরও সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না। কোন প্রকার ব্যবস্থা না নেয়ায় কিছুতেই সিন্ডিকেট মুক্ত হচ্ছে না সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের টিকিট। এবারও সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে সব ওমরা টিকিট। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজারো ওমরা যাত্রী। এ নিয়ে অভিযোগের স্তূপ পড়ছে ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন ‘আটাব’-এ।

হজযাত্রী ও ভুক্তভোগী ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর অভিযোগ মাত্র দু’টি ক্যারিয়ার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্সকে নির্ধারিত করার কারণে হজ ও ওমরার টিকিট নিয়ে প্রতি বছরই অনিয়মের ঘটনা ঘটছে। এর ফলে বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট কেনা ছাড়াও সময় মতো যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্ভোগ ও হয়রানির শিকার হচ্ছে এজেন্সিগুলো।

এ বছরের হজকে সামনে রেখেও বিমান টিকিট নিয়ে ইতোমধ্যেই শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠার অভিযোগ উঠেছে।

সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের ওমরা টিকিটের ৮০ ভাগই অনলাইন সিস্টেমে ব্লক করে কৌশলে চার-পাঁচটি বিশেষ ট্রাভেল এজেন্সিকে দিয়ে তাদের সেলসের দিক থেকে শীর্ষে রেখে আসন্ন হজের বেশির ভাগ টিকিট বরাদ্দ দেয়া হয়। শতাধিক ট্রাভেল এজেন্ট তাদের সংগঠন আটাবের কাছে বিষয়টি লিখিত অভিযোগ করেছে। যথা সময়ে ফ্লাইট পেতে টিকিট প্রতি ৫ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেশি নেয়ার ঘটনা ঘটে।

টিকিট সিন্ডিকেটের বিষয় ২০১২ সালে আটাবের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগও করা হয়। এর পর সাউদিয়া এয়ারের তৎকালীন কান্ট্রি ম্যানেজারকে প্রত্যাহার করে নতুন ম্যানেজার দেয়া হয়। কিন্তু গত বছরও বিমান সংস্থাটি টিকিট নিয়ে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে। গত বছর একটি ফ্লাইটের সব ক’টি আসনই সিন্ডিকেটভুক্ত একেকটি এজেন্সিকে দিয়ে দেয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে।

অভিযোগ রয়েছে, সৌদি এয়ারলাইন্সের ঢাকা অফিসের বেশির ভাগ কর্মকর্তা এর সাথে জড়িত। এদের গডফাদার হল লাবনী হাসনা চৌধুরী। নতুন কান্ট্রি ম্যানেজার আসার পর দ্রুত তার উত্থান দেখে সবাই হতবাকও হয়েছেন। তার অঙ্গুলির ইশারা ছাড়া কোন টিকিট বিক্রি হয় না।জানা গেছে তার নেতৃত্বে ট্রাভেল এজেন্ট সিন্ডিকেট ওমরা যাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাসহ নানা সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে এই কাজটি করছে। এ বছরও ৬/৭টি ট্রাভেল এজেন্টকে টপ লিস্টে রাখার জন্য ৮০ ভাগ ওমরাহ টিকিট দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

টিকিটের এই অনিয়মের সাথে সৌদি এয়ার ঢাকা কার্যালয়ের হজ ও ওমরাহ কো-অর্ডিনেটর লাবনী হাসনা চৌধুরীসহ সেলসের কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত বলে গত বছরও অভিযোগ ওঠেছিল। তবে লাবনী হাসনা চৌধুরী গত বছর সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। এই মহিলা কর্মকর্তাকে গত বছরের হজের পর প্রমোশন দিয়ে রহস্যকারণে সেলস অফিসার করা হয়েছে এবং আবারো হজ ও ওমরাহর কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

‘আটাব’ সূত্রে জানা গেছে, সৌদি এয়ারের ওমরাহ টিকিটের সিস্টেম ব্লক করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টিকিট বিক্রির বিরুদ্ধে আটাবভুক্ত এজেন্সিগুলো লিখিত অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ৪৪টি এবং সিলেটের ৩১টি এজেন্ট রয়েছে। আটাবের চট্টগ্রাম জোনের সভাপতি মোঃ আবু তাহের তার লিখিত অভিযোগ আটাবের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠানোর কথা স্বীকার করে বলেন, সৌদি এয়ারলাইন্সের ওমরা টিকিটের অলনাইন সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া এবং হজে টিকিট সিন্ডিকেট বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তারা দাবি জানিয়েছেন।

আটাবের চট্টগ্রাম জোনের সভাপতি আব্দুল জব্বার জলিলও এজেন্টদের লিখিত অভিযোগ পাঠানোর কথা স্বীকার করে বলেন, সৌদি এয়ারের ওমরা টিকিট আমরা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, অনলাইন সিস্টেম সবার জন্য খুলে দিয়ে টিকিট সমভাবে বণ্টন করার জন্য আমরা ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আটাবের মহাসচিব জিল্লুর আহমেদ চৌধুরী দীপুর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাউদিয়া এয়ারের ওমরাহ টিকিট সিস্টেম লক করে কয়েকটি এজেন্সিকে দেয়ার অভিযোগ সত্য।

আমরা এ ব্যাপারে সংস্থাটির সাথে মৌখিকভাবে কথা বলেছি। যেহেতু অভিযোগ সাউদিয়া এয়ারের ঢাকা কার্যালয়ের বিরুদ্ধে সেহেতু আমরা বিষয়টি তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, হজের টিকিট সিন্ডিকেট করার জন্য টপ লিস্ট তৈরি করতেই এখন ওমরাহ টিকিট নিয়ে এই কারসাজি করা হচ্ছে।

লাবনী হাসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে ফোনে জানতে চাইলে তিনি তা সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, আমরা আমাদের কান্ট্রি ম্যানেজারের ইনস্ট্রাকশনে কাজ করে থাকি। ওমরাহ টিকিটের অনলাইন সিস্টেম লক করে রাখার অভিযোগ সঠিক নয়। টিকিট নিয়ে অনিয়মের কোনো ঘটনার ব্যাপারে তিনি জানেন না বলেও দাবি করেন। আটাবের কাছে জমা হওয়া অভিযোগের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, কারা কী অভিযোগ করেছে আমার জানা নেই।

আটাব সূত্র জানায়, সৌদি এয়ারের ওমরাহ টিকিটের সিস্টেম লগ করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টিকিট বিক্রির বিরুদ্ধে আটাবভুক্ত এজেন্সিগুলো ইতিমধ্যে লিখিত অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ৪৪টি এবং সিলেটের ৩১টি এজেন্ট রয়েছে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.