ইউনাইটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারে তদন্তে নামছে দুদক

upgdবাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১৬০ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিদেশে পাচার হয়। এসব অর্থের একটি অংশ ব্রিটেনের ভার্জিন আইল্যান্ডে বিনিয়োগ করেন দেশের ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করা হচ্ছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্য আমদানি করে থাকেন বেশি দামে। আর ওই বাড়তি অর্থ পাচার হয়ে যায় বিদেশে। দেশের এ রকম অন্তত ২০ জন ব্যবসায়ীর অর্থ পাচারের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাঁরা ব্রিটেনের ভার্জিন আইল্যান্ডে অর্থ পাচার করেছেন। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতের দুই কম্পানি সামিট গ্রুপ ও ইউনাইটেড পাওয়ার রয়েছে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রায় ১৩ কোটি টাকা বেশি দাম দিয়ে জ্বালানি তেল আমদানি করেছে সামিট পাওয়ার ও বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেড। অভিযোগ উঠেছে, ওভার ইনভয়েস করা এই অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে। সম্প্রতি এই অভিযোগে দুনীতি দমন কমিশন তদন্ত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক তদন্তে ইউনাইটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিতও হয়েছে। দুদক সুত্রে এই তথ্য জানা গেছে। ইউনাইটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারে তদন্তে নামছে দুদকইউনাইটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারে তদন্তে নামছে দুদক
সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক খান এমপির পারিবারিক ব্যবসা সামিট পাওয়ার গত বছরের সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরে সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা তেলের দুটি চালানে বাজার দর থেকে অন্তত ১২ কোটি ৬২ লাখ টাকা বেশি দিয়েছে। আর ব্রিটেনপ্রবাসী ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন বারাকা পতেঙ্গা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে আনা তেলের জন্য বাজার দর থেকে ৭০ লাখ টাকা বেশি পরিশোধ করেছে। সামিট ও বারাকা পতেঙ্গার আমদানিপত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুহু রুহুল্লা কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে ফার্নেস অয়েলের দাম সমন্বয় করা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে তেল আমদানির অনুমতি দেওয়ায় তারা এর সুযোগ নিয়েছে। বেশি দামে তেল আমদানি করে সেই অর্থ যেমন পিডিবির কাছ থেকে তারা নিয়ে নিচ্ছে। একই সময় অতিরিক্ত অর্থ তারা বিদেশে পাচার করছে। পরিস্থিতি সামনে আরো খারাপের দিকে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকদের তেল আমদানির বেআইনি সুযোগ করে দিয়েছে। এর ফলে তেলের ওপর যেমন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সরকারি রাজস্ব কমেছে, তেমনি হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানিয়েছে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠানকে তেল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে তারাই কেবল বিদেশ থেকে তেল আমদানি করতে পারবে। জ্বালানির এই দাম পিডিবি পরিশোধ করে থাকে। ফলে অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে আনা এসব জ্বালানি তেলের অর্থ পরিশোধ করে পিডিবি আর জনগণের সেই অর্থ দেশের বাইরে চলে যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
জানা গেছে, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর সামিট পাওয়ার সিঙ্গাপুর থেকে ৬৫৯ দশমিক ২২ মার্কিন ডলার প্রতি টনের দর হিসেবে ১৮ হাজার ৪৬৬ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। এর সঙ্গে ২৫ ডলার প্রতি টন জাহাজ ভাড়া যোগ করলে দাম দাঁড়ায় প্রায় ৬৮৪ দশমিক ২২ ডলার। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক মূল্যবিষয়ক প্রকাশনা প্লেটসের হেডিংয়ে প্রকাশিত দর অনুযায়ী তখন ফার্নেস অয়েলের আন্তর্জাতিক মূল্য ছিল ৬১৪ দশমিক ২৭ ডলার প্রতি টন। প্রায় কাছাকাছি সময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সিঙ্গাপুর থেকে সিঅ্যান্ডএফ (কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইড অর্থাৎ জাহাজ ভাড়াসহ) ভিত্তিতে ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে প্রতি টন ৬৫১ ডলার মূল্যে। সামিটের আমদানি করা দর ও আন্তর্জাতিক বাজার দর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে প্রায় ৪৪ দশমিক ৯৫ ডলার বেশি দামে প্রতিষ্ঠানটি ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে। আর এতে করে সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কম্পানি প্রায় আট লাখ ৩০ হাজার ৪৬ ডলার অর্থাৎ ছয় কোটি ৪৭ লাখ ৪৩ হাজার ৬৪২ টাকা সিঙ্গাপুরের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত প্রদান করেছে। একই ঘটনা গত ১০ ডিসেম্বর আবার ঘটায় সামিট ১৯ হাজার ২৪৯ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে। এখানে প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের দাম দেখানো হয়েছে ৬৫১ দশমিক ৯৫ ডলার। এ তেল আনতে পরিবহন ব্যয় হয়েছে টনপ্রতি ২৩ দশমিক ৬৩ ডলার। অথচ সিঙ্গাপুরে সে সময় ফার্নেস অয়েলের দর ছিল প্রায় ৬১১ ডলার। একই মাসের ১৮ ডিসেম্বর বিপিসি সিঙ্গাপুর থেকে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করে। প্রতি টনের দাম জাহাজ ভাড়াসহ পড়েছে ৬৪৮ দশমিক ৯৫ ডলার। এ ক্ষেত্রে সামিট সিঙ্গাপুরের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত দাম পরিশোধ করেছে ৭ লাখ ৮৯ হাজার ২০৯ ডলার অর্থাৎ প্রায় ছয় কোটি ১৫ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। আর এসব অর্থ বাংলাদেশে সামিটকে পরিশোধ করেছে পিডিবি।
kalar kanthoএদিকে বারাকা পতেঙ্গা নামে আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে বেশি দামে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বারাকা পতেঙ্গা সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচ হাজার ১২০ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে ৬২৪ মার্কিন ডলার মূল্যে। এর সঙ্গে জাহাজ ভাড়া যোগ করা হয়েছে আরো ৮৮ ডলার। এ সময় সিঙ্গাপুরে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের মূল্য ছিল প্রায় ৬০৬ দশমিক ৩৬ ডলার। আর রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিপিসি গত ৩ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর থেকে (সিঅ্যান্ডএফ ভিত্তিতে অর্থাৎ জাহাজ ভাড়াসহ) ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে ৬১৩ ডলার মূল্যে। আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য থেকে বারাকা পতেঙ্গা ১৭ দশমিক ৬ ডলার অতিরিক্ত দামে ফার্নেস অয়েল আমদানি করেছে। এ ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ৯০ হাজার ১১২ ডলার অর্থাৎ ৭০ লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬ টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের উপমহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মনোয়ার আহমেদ বলেন, ‘শুধু নিজেদের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল আমরা আমদানি করে থাকি। এ ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসের কোনো সুযোগ নেই। যদি আমরা ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান হতাম, তাহলে এমন অভিযোগ যুক্তিসংগত হতো।’
১০ বছরে পাচার হয়েছে এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা : প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে পাচার হয়। ‘ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ : ২০০২-২০১১’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অন্তত এক হাজার ৬০৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা এক লাখ ২৮ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে চলে গেছে। এটি বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরের মোট বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি। পাচার হয়ে যাওয়া এসব অর্থ জমা হয়েছে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এবং করের সুখস্বর্গ (ট্যাক্সেস হেভেন) বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে। বিশ্বের যে ১৫০টি উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
জিএফআইয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভ কার ও অর্থনীতিবিদ ব্রায়েন লা ব্লাংক এ প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ডেভ কার এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তাঁদের ওই প্রতিবেদন মতে, গড়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১৬০ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার হয়।
পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ গেছে ব্রিটেন : ব্রিটেনের ভার্জিন আইল্যান্ডে কোনো অর্থ বিনিয়োগ করলে এর উৎস জানতে চাওয়া হয় না। আর এর সুযোগ নিয়েছে গত কয়েক বছরে অন্তত ২০ জন দেশি ব্যবসায়ী। তাঁরা সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ নিয়ে ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছেপেছে। বাংলাদেশ থেকে কৌশলে পাচার হওয়া অর্থ ভার্জিন আইল্যান্ডে যারা বিনিয়োগ করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড পাওয়ার। আর এ দুটি কম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবসা রয়েছে, তারা বিদেশ থেকে তেল আমদানিরও অনুমতি পেয়েছে অনেক আগেই।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ফারুখ খান এমপির ভাই সামিট পাওয়ারের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ খান, স্ত্রী আঞ্জুমান আজিজ খান, মেয়ে আয়শা আজিজ খান, ভাই জাফর উম্মেদ খান ও বোনের ছেলে মো. ফয়সাল করিম খান- এই পাঁচজনের নামে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে নিজেদের নামে কম্পানির শেয়ার কিনেছেন। আর ঠিকানা দিয়েছেন সিঙ্গাপুরের। সামিট গ্রুপের এই প্রভাবশালী পরিবারের পাঁচ সদস্য বেকিংসডেল লিমিটেড ((Beckingsdale)), গ্রোথেনভিল লিমিটেড (Grattanville)) ও বর্নিও পাওয়ার লিমিটেড (Borneo Powers) নামের তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক বা পরিচালক। ভার্জিন আইল্যান্ডে বিনিয়োগের তালিকায় রয়েছেন অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবসায়ী ইউনাইটেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান মাহমুদ রাজা। তিনি মাল্টিট্রেড মার্কেটিং লিমিটেড নামের একটি কম্পানির মালিক (Multi-Trade Marketing Ltd))।
অভিযোগ সম্পর্কে জানার জন্য সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ খানের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে গতকাল রাতে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
অন্য অভিযুক্ত ইউনাইটেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান মাহমুদ রাজা সিঙ্গাপুরে থাকায় তাঁর মতামত নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এই প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ কম্পানি ওয়েস্টমন্ড পাওয়ারের কম্পানি সচিব ইবাদত হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার বিদেশে আছে এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তিনি এলেই এ ব্যাপারে বলতে পারবেন।’
উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়াম লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৮ সালে খুলনা পাওয়ার কম্পানিকে তেল আমদানি করার অনুমতি দেওয়া হয়। বেসরকারি খাতে সেটাই ছিল প্রথম কোনো তেল আমদানির অনুমতি। আর এ কম্পানিটির যৌথ মালিকানা রয়েছে সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে। এর বাইরে ইউনাইটেড গ্রুপের সিরাজগঞ্জে ১০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে।

আরও খবর
আপনার কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published.